‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব:৯]

সকাল থেকেই একটা বিষন্নতা ছেয়ে আছে মনে । এই কয়েকদিনেই যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে সেই বাঁধন আজ ছেঁড়ার পালা । সকাল সকাল উঠে গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে । কাকাবাবু আমাদের সঙ্গে ফিরবেন না । কয়েকদিন পরে ফিরবেন । আমি, মেজ আর ছোট ফিরে আসছি । বড় দাদাবাবু আর দেবাশীষ ভোমরার বর্ডার পর্যন্ত আসবেন আমাদের এগিয়ে দিতে । শেষবারের মত পুকুরের জলে গা ভাসিয়ে দিলাম । আজ আর দাপাদাপি করার ইচ্ছে হল না । বাড়ি ফিরে খেয়ে জামাকাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিলাম । সারা বাড়িতেই একটা বিষণ্ণতার ছায়া । সকাল থেকেই এ-বাড়িতে লোকের মেলা । আমাদের বিদায় জানাতে বরুণ, কর্ণ, কুমারেশ, প্রলয় ও আরও অনেকে উপস্থিত হয়েছে । বড়দিদি সন্তানাদি সহ ফিরে যাবে আজকে । আমাদের সঙ্গেই রওনা হবে । আমাদের বিদায় জানাতে জড়ো হওয়া জনা পঁচিশেক নরনারীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম । গ্রাম্য সারল্য মাখা চোখগুলো যেন বলছে, ওরে যাসনে, আর কটাদিন থেকে যা । কিন্তু আমাদের সে উপায় নেই । সকলেরই টিকি কোথাও না কোথাও বাঁধা আছে । নির্জন মাঠে ঘাস খেতে খেতে গরু যেমন অনেকদূরে কোথাও চলে যেতে পারে না, খুঁটিতে টান পড়ে । তেমন আমাদেরও খুঁটিতে টান পড়েছে । আর যাওয়া যাবে না ।
আমরা রওনা হয়ে পড়লাম । পিছন পিছন পুরো দলটা আসছে । শ্রীধরপুরের মোড়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই । এবার সকলের থেকে বিদায় নেবার পালা । সকলের মনেই একটা বিষন্নতার মেঘ জমেছে । দেবুদার ছলছলে চোখের পানে চাইতে পারলাম না । ইতিমধ্যে দাদাবাবু একটা টোটো থুড়ি ইজি বাইক ঠিক করে ফেলেছেন । বড় দিদি আর আমরা চেপে বসলাম । বড়দি রাস্তায় নেমে যাবে । গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে । পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে নেড়ে নেড়ে শেষ বিদায় জানালাম । ঝোড়ো হাওয়ায় রুমাল উড়তে লাগলো । মনটা ভারী হয়ে গেল । এখানকার মানুষজন, মাঠ, ঘাট, ধানের ক্ষেত, শষ্যশ্যামল প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত মাছের ঘের, নীলাকাশ, ঝোড়ো হাওয়া সবকিছুকে ভীষণ মিস করবো । দেশে ফিরে আর পুকুরের জল খাব না, তিনবেলা খেতে বসলে আতপ চালের ভাতও দেবে না কেউ, কেউ হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রলয়ের দাদুর দোকানের প্রচন্ড কষ লিকার চা খাওয়াবে না, সন্ধ্যার প্রাক্কালে ধানক্ষেতের ধারে বসে রতন চানাচুর খেতে খেতে আড্ডা দেব না আর, মাঝরাতে কপোতাক্ষর শীতল হাওয়ায় ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চাদর টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শোব না, এগুলো ভাবলেই মনটা ভেজা তুলোর মত ভারী হয়ে উঠছে । দুপাশে ফাঁকা জমি, বাড়িঘর, মানুষজন পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ।

রাজহাঁসের বাচ্চা কোলে . . .
সেই পুকুরপাড় . . .
ঢং করে উকুন বাছা . . .
মনে পড়বে সে দিনগুলো . . .

একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম । টোটো থামতে চমক ভাঙলো । দিদি নেমে যাচ্ছে । সকলেই নামা হল । দিদিকে ছেলেমেয়ে সমেত অন্য একটা ভ্যানে তুলে রওনা করিয়ে দিয়ে আমরা টোটোয় ফিরে এলাম । কুল্যার মোড় পৌঁছতেই বাস পেয়ে গেলাম ।  বাসে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে চলেছি । বাস চলেছে শম্বুক গতিতে । সঙ্গে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে অকারণ বিলম্ব তো আছেই । আজ কিন্তু ততটা খারাপ লাগছে না । মনে হচ্ছে যেন বাসটাও আমাদের চলে যাওয়াতে বিষণ্ণ । যেন খানিক্ষণ আর আটকে রাখাই বিলম্বের কারণ । কিন্তু শামুকও কখনও না কখনও গন্তব্যে পৌঁছয় । আমরাও সাতক্ষীরা পৌঁছলাম । কিছু কেনাকাটা করার ছিল । যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে ভোমরার টেম্পো ধরলাম । একেবারেই জরাজীর্ণ মৃতপ্রায় টেম্পো আমাদের নিয়ে চলল । টেম্পো আমাদের শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়েছে নাকি আমরা টেম্পার শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছি বোঝা যাচ্ছিল না । সারাটা রাস্তা অনর্গল বায়ু ও শব্দদূষণ চলতে থাকলো । অবশেষে বেলা একটা নাগাদ ভোমরা পৌঁছলাম । টেম্পো থেকে নেমে আমরা হেঁটে এলাম বর্ডার পর্যন্ত । কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পেরিয়ে শেষ বিদায় জানাবার জন্য প্রস্তুত হলাম । দেবাশীষরা এর বেশি এগোতে পারবে না । আমরা কোলাকুলি করে বিদায় চাইলাম । দাদাবাবু একগাল হাসি নিয়ে বিদায় জানালেন । দাদাবাবুর ঝকঝকে উজ্জ্বল হাসির পিছনে লুকনো মনখারাপের অন্ধকারটা আমার চোখ এড়ালো না । আমরা আর দাঁড়ালাম না । খারাপ লাগাটা যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছিল । দুদেশের মাঝের ছোট্ট খালটা পেরিয়ে একবার দাঁড়ালাম । পিছন ফিরে একবার তাকালাম । বিষণ্ণ উদাস চোখে কিছুই ভাল ঠাহর করতে পারলাম না । মাথা নীচু করে হেঁটে পেরিয়ে এলাম ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ । প্রবেশ করলাম ভারতবর্ষে ।

[সমাপ্ত]

One thought on “‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

    […] এদিকে vairalnews.com এর প্রতিবেদনে উকুন বাছার যে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটি পাওয়া গেছে ১৩ জুলাই, ২০১৭ সালে “বাংলার গ্রাম-গ্রামের বাংলা” শীর্ষক একটি ব্লগ আর্টিকেলে। […]

    Like

Leave a comment