ভ্রমণ

দেবতার দেশ

Posted on Updated on

অনেকদিন পর আবার বেরিয়ে পড়া গেল । আবার পাহাড়, আবার হিমালয় । এবার আমাদের গন্তব্য ‘উত্তরাখণ্ড’ । সংস্কৃতে যার অর্থ ‘দেবভূমি’ বা ‘দেবতার দেশ’ ।
মার্চ মাসের সাত তারিখ । বেলা ১টা নাগাদ হাওড়া স্টেশন থেকে ‘কুম্ভ এক্সপ্রেসে’ রওনা হওয়া গেল । অপরাপর নিম্নচাপ ও বৃষ্টিপাতের জেরে কলকাতায় ঠান্ডার প্রকোপ পুনরায় ফিরে আসায় আবহাওয়া বেশ মনোরম ।

৮ই মার্চ ২০১৯
ঘড়িতে সময় বিকেল পাঁচটা । হরিদ্বার পৌঁছলাম অবশেষে । ₹১৫০ টাকার বিনিময়ে কুলি মারফৎ মালপত্র নিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম । গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল । ঋষিকেশে থাকার ব্যবস্থা । যাওয়ার পথে ‘কংখল’-এ আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম দেখে যাওয়া হবে । মালপত্র বেঁধে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম ।
চলেছি হরিদ্বার শহর দেখতে দেখতে । কত সাধু সন্ন্যাসীর, কত মহাপুরুষের পদধূলি পড়েছে এই স্থানে । পুরাণের চরিত্রদের এককালের আবাসভূমি এই শহর । মহাকাব্যের চরিত্রদের নিয়ে কত কিংবদন্তি এখানকার হাওয়ায় ভাসে এখনও । আর সেই কিংবদন্তিদের বাস্তব রূপ দিতে চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অজস্র মন্দির । বারাণসী বা বেনারসকে যদি ‘ঘাটের শহর (City of Ghats)’ বলা হয়, তবে হরিদ্বারকে ‘মন্দিরের শহর (City of Temples)’ বলা যায় অনায়াসে । তবে এখানেও ঘাটের সংখ্যা নেহাত কম নয় ।
শহরের যানজট কাটিয়ে আধঘন্টার মধ্যে আনন্দময়ী মার আশ্রমে এসে পড়লাম ।IMG-20190331-WA0000[1] আনন্দময়ী মা বা মা আনন্দময়ী হলেন একজন আধ্যাত্মিক সাধিকা জিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৬ সালের ৩০ এপ্রিল অবিভক্ত বাংলার ত্রিপুরার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খেওড়া গ্রামে । তার পিতা বিপিনবিহারী ভট্টাচার্য মুক্তানন্দ গিরি নামে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন । সেই সুত্রেই তার মধ্যেও খুব ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হয় । তার প্রকৃত নাম নির্মলাসুন্দরী দেবী । ১৯২৪ সালে স্বামী রমণীমোহন চক্রবর্তীর সঙ্গে ঢাকা আসেন এবং সিদ্ধেশ্বরীতে কালীমন্দির স্থাপন করেন । এই মন্দিরেই একদিন দিব্যভাবে মাতোয়ারা নির্মলা আনন্দময়ী মূর্তিতে প্রকাশিত হন এবং তখন থেকেই তার নাম হয় ‘আনন্দময়ী মা বা মা আনন্দময়ী’ । ১৯৩২ সালে আনন্দময়ী স্বামীর সঙ্গে উত্তরভারতের দেরাদুনে চলে আসেন । পরে এই কংখলেই ১৯৮২ সালের ২৭ আগস্ট তিনি দেহত্যাগ করেন । ভারত ও বাংলাদেশে তার নামে প্রায় ২৫টি আশ্রম,বিদ্যাপীঠ,হাসপাতাল ইত্যাদি আছে । ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার, সংগ্রহশালা ছেড়ে এগিয়ে গেলাম সমাধিক্ষেত্রের দিকে । শ্বেত পাথরের মন্দিরের আকারে গঠিত সমাধিক্ষেত্র ও সমগ্র প্রাঙ্গণ । সেইসঙ্গে সযত্নে রক্ষিত আছে মহীরুহের আকার নেওয়া সেই প্রাচীন রুদ্রাক্ষ গাছ ।
সমাধি চত্বরে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে এবার হোটেলের পথে রওনা হয়ে পড়লাম । আমাদের প্রাথমিক আস্তানা ঋষিকেশের ‘গ্রীন হিলস কটেজ’ ।
হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ পৌনে একঘন্টার রাস্তা । হোটেল যখন পৌঁছলাম তখন আটটা বাজে । লছমনঝুলা রোডের উপর ছিমছাম তিনতলা গাঢ় সবুজ বাড়ি, গাছপালা সমৃদ্ধ একটা ছোট্ট বাগান আর একটা ছোট্ট পার্কিং লট নিয়ে এই হোটেল । বাগানে বিভিন্ন কেয়ারী করা গাছ । সুন্দর কাঠের চেয়ার-টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা । পাশেই হোটেলের নিজস্ব রেস্তোরাঁ । সমস্ত জায়গাটাতে টুকরোটাকরা শিল্পের ছোঁয়া ছড়িয়ে আছে ।
কাঁচের দরজা ঠেলে রিসেপশনে এসে দাঁড়ালাম । পরিচয়পত্র দেখিয়ে রেজিস্টারে সই করে আমাদের কর্তব্য যথাযতভাবে পালন করলাম । এবার একজন স্টাফ আমাদের দোতলার একটি ঘর খুলে দিলেন । বড়সড় তিনজনের ব্যবস্থাসহ একটি ঘর । ঝাঁ চকচকে বাথরুম । পিছনের দরজা খুললেই ওপাশে একফালি ছাদ । সেখানে বেতের চেয়ার টেবিল পাতা আছে । ছাদে বসলে রাস্তার চলমান গাড়ি, আশপাশের দু-চারটে হোটেল আমাদের বাগানের খানিকটা অংশ আর গাছপালার ফাঁকে বেশ কিছুটা পাহাড় দেখা যায় । সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বইছে । আমরা মালপত্র সহ ঘরে এসে গেড়ে বসলাম ।
ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । ততক্ষণে ফোনে নিচে রেস্তরাঁয় এক প্লেট করে চিলি পনির আর চিলি পটেটো অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে । সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজও যুক্ত হল একটু পরে । সঙ্গে দুটো সোডার বোতলও আনতে বলা হয়েছে ।
স্ন্যাকস এসে গেল একটু পরেই । সঙ্গে সোডা । এবার স্যুটকেস থেকে বেরোল কলকাতা থেকে আনা একটা স্কচ হুইস্কির বোতল । জনি ওয়াকার, রেড লেবেল । সিঙ্গেল মল্ট । বন্ধুপ্রবর হিমাদ্রী তিনটে কাঁচের গেলাসে সুরা ও সোডার সঠিক অনুপাত নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । খনিকের মধ্যেই আমাদের হাতে যে পাত্রগুলো উঠে এল তার মধ্যে থেকে যেন সোনালী রঙের বিচ্ছুরণ ঘটছিল । একচুমুক দিয়েই গা টা কেমন পাক দিয়ে উঠল । আমার আবার তেমন অভ্যেস না থাকায়, মাঝেমধ্যে গলায় ঢাললে পরে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে ক্রিয়া হবার একটা প্রবণতা আছে । অন্তত সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না । মশলা মাখানো একটা পনিরের টুকরো ক্যাপসিকামের সহিত মুখে ফেলে চোখ বন্ধ করে চিবুতে লাগলাম । আহঃ, তুলতুলে পনিরের টুকরোটা মুখের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল । আস্তে আস্তে প্লেটের খাদ্যসামগ্রী ও পাত্রের তরল উভয়েই যথাক্রমে নিঃশেষিত হল । সান্ধ্যভোজ সমাধা হতেই সাড়ে নটা বেজে গেল । ইতিমধ্যে রাতের খাবারের ডাক এসে গেল । পাহাড়ি এলাকা, বেশি রাত পর্যন্ত জাগা এখানকার রীতিবিরুদ্ধ । অবশ্য শুধু ঋষিকেশ বলে নয়, প্রায় সমস্ত পার্বত্য এলাকায় এই একই নিয়ম প্রচলিত । অতএব কিছু করার নেই । একবারে খাওয়ার উপর খাওয়া । উপরিপর সান্ধ্য এবং নৈশভোজ সমাধা করে, পাকস্থলীকে সাহায্য করার জন্য দুটো হজমোলার বড়ি মুখে ফেলে শুতে গেলাম ।

৯ই মার্চ ২০১৯
সকাল সকাল স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিয়ে নিচে বাগানে চলে এলাম । ব্রেকফাস্টের অর্ডার দেওয়া হয়েছে । গাছের ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি নরম রোদ এসে সমস্ত বাগানে ছড়িয়ে পড়ছে । বাতাসে হালকা শীত শীত ভাব । বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা টেবিলগুলোতে বিদেশীদের প্রাদুর্ভাব । কেউ অত্যন্ত নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে, কেউ বা প্রকৃতির রসাস্বাদনে ব্যস্ত । পৃথিবীর বিভিন্ন কোনা থেকে তাঁরা এসেছেন আধ্যাত্বিকতার টানে । আমাদের প্রাতঃরাশ এসে গেল । বাটার টোস্ট আর স্পিনাচ ফিটা অমলেট । সঙ্গে ট্রিপল লেয়ার প্যানকেক । অনেক নতুন নতুন খাদ্যগ্রহণ করে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, কিন্তু পালংশাক দিয়ে অমলেট ! এখনও খাওয়া হয়নি । সেই ঝুলিতে একটা নতুন অভিজ্ঞতা জমা হল এবার ।
গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য । খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম । গন্তব্য পরমার্থ নিকেতন । শহরের পাশে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার অপরদিকে এই আশ্রম । আগেরদিনই হোটেলে আসার পথে রামঝুলা দেখেছিলাম । আজ আশ্রম যাবার পথে দেখলাম লছমনঝুলা । ঝুলা হল গঙ্গার উপরে ঝুলন্ত ব্রীজ । দেবতার দেশে ব্রীজও দেবতার নামেই নামাঙ্কিত । রাস্তায় আসার পথে দেখছিলাম অধিকাংশ হোটেল, আশ্রম, ধর্মশালা, যাত্রী আবাস দেবদেবীদের নামাঙ্কিত ।
আমরা যখন আশ্রম পৌঁছলাম তখন রোদ বেশ চড়া হয়ে গেছে । এখানকার আশ্রম, ঘাট এবং মন্দিরগুলোতে যেন দেশীয়দের থেকে বিদেশীদের ভীড় বেশি । যত্রতত্র তারা দেশীয়দের পোশাকে ঘুরছে, দেশীয়দের খাবার খাচ্ছে, ছবি তুলছে, কেনাকাটা করছে । গঙ্গার তীরে এই আশ্রমে কয়েকদিন আগেই আন্তর্জাতিক যোগ উৎসব সম্পন্ন হয়ে গেছে । আমরা ঘাটে গিয়ে বসলাম । গঙ্গা বয়ে চলেছেন । বরফশীতল নীল জল । গভীরতা খুবই কম কিন্তু স্রোত ভীষণ । ঘাটের ধার দিয়ে টানা শেকল লাগান আছে পুণ্যার্থীদের জন্য । পুণ্যস্নান করতে গিয়ে স্রোতের মুখে যাতে ভেসে না যান কেউ তার জন্য এই ব্যবস্থা । কলকাতায় গঙ্গা দেখেছি অজস্রবার, কিন্তু এখানে এসে যেন বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে যে এটা সেই গঙ্গা । উৎসের কাছে এইস্থানে জলের বর্ণ নীলাভ । দেখলে, স্পর্শ করলে চোখ মন জুড়িয়ে যায় । ভক্তি চলে আসে অন্তরে, জোর করে আনতে হয় না । অথচ সমতলে সাগরে মিলিত হবার কাছে তার কি অবস্থা । অবস্থা না বলে দুরবস্থা বলাই শ্রেয় । শুনেছি গঙ্গায় স্নান করলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায় । বুঝতে পারছি উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত অসংখ্য মানুষের কৃতকর্ম বুকে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে মা গঙ্গা এখন ধুঁকছেন । কুসন্তানদের কুকর্ম নিজ বুকে টেনে নিয়ে তিনি নিজেই এখন কলুষিত হয়ে পড়েছেন ।
ঘাটের ধার দিয়ে একটা ছোট্ট মার্কেট চত্বর । নানারকম সামগ্রীর সম্ভার । কোন দোকানে রুদাক্ষ ও নানারকম পাথরের মালা, আংটিসহ অজস্র জিনিস, কোথাও বা এখানকার বানানো কাপড়ের সম্ভার, আবার কোথাও শীতবস্ত্র । কোনটা বা খাবার হোটেল ।
কিছু কেনাকাটা সেরে বেরিয়ে এলাম । মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেছে । গুগল ম্যাপে একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে দেখে সেদিকেই ধাবিত হওয়া গেল ।
লছমন ঝুলার কাছাকাছি একটা গলিপথে লম্বা চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে । বেশ অনেকটা নেমে আসার পর ডানহাতে একটা ছোট্ট গুহাদ্বারের মত প্রবেশপথ দেখা গেল । দুধাপ সিঁড়ি নামতেই চোখে পড়ল কাঁচের দরজা । ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল । তার কয়েকটি কারণ আছে । প্রথমত ঢুকেই সামনে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে দ্বিপ্রহরের ক্ষুধা না মিটলেও মনের খিদে মিটে গেছিল । টানা খোলা ঝুলবারান্দা এবং তার রেলিঙের ওপাশে বিশাল খোলা জায়গা । বিস্তৃত পাহাড়, নিচে স্রোতস্বিনী গঙ্গা, সব মিলিয়ে শিল্পীর তুলির টানে আঁকা অপূর্ব ক্যানভাস । তার উপরে এই ক্যাফেতে বিদেশীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত । সারা ক্যাফেতে জনা চারেক কর্মচারী, জনা ছয়েক এদেশীয় অবাঙালি ও আমরা ছাড়া ক্যাফেতে উপস্থিত প্রায় জনা চল্লিশেক মানুষের সবাই লালমুখো সাহেব মেম । ছড়ানো ছিটানো বসার ব্যবস্থা । কিছু সোফা, কিছু চেয়ার আবার কিছু বা তাকিয়া সহ ডিভান । ক্যাফের সৃষ্টিকর্তা ইংরেজি ‘বিটলস্’ ব্যান্ডের থেকে ভীষণভাবে প্রভাবিত । তাই রেস্তোরাঁর নাম ‘বিটলস্ ক্যাফে’। সমগ্র ক্যাফেটেরিয়ায় বিটলসের ছবি, পোস্টার, কর্মকান্ডের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে ।

১০ই মার্চ ২০১৯
Image result for mercury shiva lingam harihar ashramব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে । যাব কংখলে হরিহর আশ্রম । আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম বাঁহাতে রেখে দক্ষেশ্বর শিব মন্দির ডানদিকে ফেলে খানিকদূর গেলেই হরিহর আশ্রম । এই আশ্রমেও আনন্দময়ীর আশ্রমের মত রুদ্রাক্ষের গাছ আছে । এই আশ্রমের মূল বৈশিষ্ট্য হল এখানে স্থাপিত ১৫১ কিলো ওজনের খাঁটি পারদের শিবলিঙ্গ । প্রতিবছর প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এখানেও ।
ঋষিকেশের দিকে রওনা দিলাম । বেলা হয়ে যাচ্ছে, একটা হোটেল খুঁজে বসতে হবে । যৌথভাবে গুগল এবং ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে একটা হোটেলে পৌঁছন গেল । ‘ডিভাইন রিসর্ট’ । একপাশে হোটেল, সামনে অনেকটা ছড়ানো ছাদ । তার উপরে ছোট আরেকটা ছাদ তৈরি করা হয়েছে । দুটি ছাদেই বসার ব্যবস্থা আছে । তিনদিক খোলা । বিস্তীর্ণ আকাশ, পাহাড়, নদীর দৃশ্য উন্মুক্ত । পরিবেশ অনবদ্য । এবার মেনু কার্ডের দিকে অগ্রসর হওয়া যাক । আমার কাছে অবশ্য পরিবেশ ছাড়া প্রায় সবই সমান । কারণ সবই নিরামিষ । অথচ নিরামিষ এর পদও বেশি নেই । পনির, আলু, পেঁয়াজ, ফুলকপি, পালংশাক এবং কিছু ক্ষেত্রে ক্যাপসিকাম । এই হল কাঁচামালের নমুনা । একজন বাঙালির রসনার কাছে এখানকার বড় রেস্তোরাঁর রান্না বালখিল্যতার নিদর্শন । আমাদের মায়েরা এর থেকে অধিকতর সুস্বাদু রান্না করেন ।
যাই হোক রিস্ক না নিয়ে ধোসা অর্ডার দেওয়া হল । এই খাদ্যটি যেমন তেমন হলেও খাওয়া চলে । খাবার এল, কিন্তু যেমন আশা করা হয়েছিল তেমন নয় । ধোসা ঠান্ডা হয়ে গেছে, সঙ্গে চিরাচরিত নারকেলের চাটনি নেই । সম্বর ডালের বদলে একটা অদ্ভুত স্বাদবিশিষ্ট ঝোল তরকারি । মুখে তোলা দায় । কোনক্রমে ধোসাটা চিবিয়ে শুকনো মুখে এবং প্রায় খালি পেটে বিল মিটিয়ে হোটেলের মুণ্ডপাত করতে করতে উঠে আসতে হল । যাকগে সঙ্গে প্রচুর শুকনো খাবার আছে । একবেলা এদিক ওদিক করে হয়ে যাবে ।
এবার চললাম ত্রিবেণী ঘাটের দিকে । ঋষিকেশ এর এই ঘাটটি গঙ্গা আরতির জন্যে প্রসিদ্ধ । গঙ্গা এখানে তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বয়ে চলেছে, যেন তিনটি বেণী । তাই এই ঘাট ত্রিবেণী ঘাট নামাঙ্কিত হয়েছে । এখানে নদীর গভীরতা বেশ কম হওয়ায় এবং জল অত্যন্ত পরিস্কার হওয়ায় নিচের পাথর পর্যন্ত দৃশ্যমান ।
ত্রিবেণী ঘাট বেশ লম্বা চওড়া পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ঘাট । জুতো নির্দিষ্ট জায়গায় খুলে প্রবেশ করতে হয় ঘাট চত্বরে । সরু লম্বা কার্পেটের টুকরো সিঁড়ির উপর বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হয়েছে । নদীর জলের দু-ধাপ উপরে একটা চওড়া চাতাল । সেখানে সারি দিয়ে লোহার চৌকি রাখা আছে । তার উপরে প্রাত্যহিক গঙ্গা আরতি এবং দেবী বন্দনার সরঞ্জাম । এর উপরে উঠেই অষ্টাত্তরশত প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে আরতি সুসম্পন্ন হবে ।
আমরা জায়গা দেখে বসে পড়লাম । এখানে টাকার বিনিময়ে ব্যক্তিগতভাবে আরতি দেওয়া যায় । সাড়ে ছটা নাগাদ ভজনগীতির মাধ্যমে আরতি শুরু হল । বড় মনোরম সে দৃশ্য । এর আগে ইন্টারনেটে বেনারসের আরতির ছবি দেখেছিলাম । আগেরদিন হরিদ্বারে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হল । আজ এখানে দেখছি । প্রতি স্থানেই এই আরতির যেন একটা নিজস্বতা আছে । আরতি শেষে নিমকি সহযোগে চা খেয়ে হোটেলে ফিরলাম । পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, সেই হেতু ব্যাগ গুছিয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া হল ।

১১ই মার্চ ২০১৯
সাতসকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । প্রাতঃরাশ করার সময় নেই । রাস্তায় কোথাও করে নেওয়া হবে । পাহাড়ি রাস্তায় চড়াই উৎরাই ভাঙতে ভাঙতে চলতে লাগলাম । একসময়ে দেবপ্রয়াগ এসে গেল ।20190311_112841[1] এই স্থানে ভাগীরথী আর অলকানন্দা মিলিত হয়েছে । সৃষ্টি হয়েছে গঙ্গার । এই স্থানে ভাগীরথী ওরফে গঙ্গা আমাদের সঙ্গ ত্যাগ করল । আমরা এগোতে লাগলাম অলকানন্দাকে সঙ্গিনী করে । কিছুদূর গিয়ে একটা পদের হোটেল দেখে পাকস্থলী জানান দিল এবার কিছু খাওয়ার দরকার । এখানে মেনুকার্ডে চোখ বুলিয়ে চোখের শান্তি হল । মেনুকার্ডের একটা অংশে ননভেজ লেখা এবং তার নিচে বেশ কিছু চিকেন দিয়ে শুরু হওয়া নাম দেখে প্রাণে জল এল । নাঃ, এখনও হতাশায় ডুবে যাওয়ার দিন আসেনি তবে ! যাকগে আমিষ উপকরণের নাম দেখেও যদিও আমরা তরকারি সহযোগে আলুর পরোটা এবং চা খেয়েই আবার গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম । আজ সারাদিনটা পথেই কাটবে আন্দাজ করতে পারছি । রুদ্রপ্রয়াগ এখনও চল্লিশ কিলোমিটার বাঁকি । আমাদের চালককে বলাই ছিল আমিষ পাওয়া যায় এমন কোন ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করাতে । রাস্তার ধারে টিন দিয়ে ঘেরা একটা ঝুপড়ি মত দোকানে গাড়ি দাঁড়াল । দোকানের চেহারা দেখে ভক্তি হল না । জিজ্ঞেস করে দেখলাম মাছ এবং মাংস সবই পাওয়া যাবে । এতদিন নিরামিষ খাওয়ার পর মাছ এবং মাংস দুটোই পাওয়া যাবে শুনে আমরা যেন দিশেহারা হয়ে পড়লাম । প্রত্যেকের মাথা পিছু একপ্লেট করে মাছ-মাংস দুটোই অর্ডার দেওয়া হল । আমাদের চালক মাছ খায় না । ওর শুধু মাংস আর রুটি । খাবার এল খানিক পরে । খেয়ে দেখলাম স্বাদ মন্দ নয় । অলকানন্দা থেকে ধরে আনা ট্রাউটের মত একজাতীয় মাছ । সরু লম্বা, রূপোলী ছোট ছোট আঁশ । খেতে নরম । দোকান দেখে ভক্তি না হলেও খাবারটা খারাপ নয় । গুরুভোজন শেষে আবার যাত্রা শুরু করলাম । একসময় রুদ্রপ্রয়াগ চলে এল । এই স্থানে অলকানন্দা এবং মন্দাকিনী নদী মিলিত হয়েছে । দুটোই প্রবল স্রোতস্বিনী । রুদ্রপ্রয়াগকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম । রাস্তা অত্যন্ত খারাপ । আর দুমাস পরেই চারধাম যাত্রা শুরু হবে । সেই উপলক্ষ্যে রাস্তা চওড়া হচ্ছে । সমগ্র রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি এবং পাহাড় কেটে রাস্তা বের করার প্রক্রিয়া চলছে । এর ফলে জায়গায় জায়গায় থেমে যেতে হচ্ছে । কোথাও পনেরো কুড়ি মিনিট, কোথাওবা আধঘন্টারও বেশি । ২০১৩ সালে কেদারনাথে প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছিল । প্রচুর লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল । প্রচুর লোক হয়েছিল ঘর ছাড়া । যে হারে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে আরেকটা বদ্রীনাথ বিপর্যয় হলে অবাক হব না । আজ রাতটা উখিমঠে থাকার কথা । আগামীকাল যোশীমঠ রওনা হব । উখীমঠ যখন পৌঁছলাম সূর্য তখন পাটে যেতে বসেছে । নির্দিষ্ট হোটেল খুঁজে বের করতে খানিক্ষণ সময় গেল । আমাদের আজ রাতের আস্তানাটি মূল বাজারে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে । আমরা চেক ইন করে মালপত্র নিয়ে যখন হোটেলে ঢুকে পড়লাম, বাইরে তখন টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে । সেইসঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে । রাত্রে তাপমাত্রা যে বেশ ভাল পরিমাণে কমবে তা বোঝা গেল । রুমহিটার না থাকলেও বিছানায় মোটা লেপ এবং বাথরুমে গিজার থাকায় খুব বেশি চিন্তিত হবার কারণ নেই । সারা শরীর ধূলিধূসরিত । লাগেজ ধূলোয় স্নান করে উঠেছে । হোটেলের আমাদের দেখা একমাত্র কর্মচারী পাহাড়ি ছোকরার কাছে একটা কাপড় চেয়ে নিয়ে নিজেই সাফ করে ফেললাম ব্যাগপত্র । গিজারে জল গরম করে করে মাথা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেললাম । হাতমুখ ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে ক্রিম লাগিয়ে কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম । চা বলা ছিল । চা আসতে রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দেওয়া গেল । ধোঁয়া ওঠা চা আর আমাদের সঙ্গে আনা বিস্কুট দিয়ে চা পর্ব শেষ হল । সাড়ে নটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে । পরের দিনও সকাল সকাল বেরোনো । কলকাতায় সাড়ে নটায় শোবার কথা কল্পনাই করা যায় না । তবে এটা পাহাড় । এখানকার নিয়মকানুন আলাদা । রাত্রে গরম গরম রুটি পনির আর ডিমের ডালনা খেয়ে শয্যা নিলাম । বাইরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে সমানে ।

১২ই মার্চ ২০১৯
সকালে ঘুম ভাঙলো কম্বলের ওম গায়ে জড়িয়ে । রাত্রে ঠিক করাই ছিল তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে । হাতমুখ ধুয়ে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম । আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাইরে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে । রাস্তাঘাট এখনও ভিজে । মালপত্র গাড়িতে তুলে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । গন্তব্য যোশীমঠ । আবহাওয়া ঝকঝকে । নীল আকাশে সাদা তুলোর মত মেঘ চরে বেড়াচ্ছে । তার থেকেও সাদা বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া দেখা যাচ্ছে দূরে । প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর রাস্তার দুধারে বরফের প্রদর্শনী শুরু হল । এখানে ওখানে যেন সাজানো আছে বরফের ভাস্কর্য । আমরা দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম । যত এগোই তুষারের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পেতে থাকে । আরও কিছুটা এগিয়ে একটা দোকান দেখে চা পানের উদ্দেশ্যে নেমে পড়লাম । জায়গার নাম বেনিয়াকুন্ড । চোপতা আর খানিক্ষণ এর রাস্তা । রাস্তাটা বাদ দিয়ে সারা প্রান্তর বরফে মোড়া । রাস্তা থেকে বরফ সরিয়ে সদ্য পরিস্কার করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে । আমরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিলাম ।
খানিক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার রওনা হলাম । যত এগোচ্ছি বরফ তত বাড়ছে । এক জায়গায় আমাদের চালক হঠাৎ গাড়ি ধার ঘেঁসে দাঁড় করিয়ে দিলেন । ব্যাপারটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো । বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম আমাদের সামনের গাড়িটি পিছলে নিচের দিকে নেমে এসে সামান্য গোত্তা খেয়ে বরফের দেওয়ালে ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল । চালক জানিয়ে দিলেন এমন অবস্থায় আর এগোনো নিরাপদ নয় । রাস্তায় বরফের স্তর জমে আছে । গাড়ির চাকা পিছলে যাবে । আমরা এই কথা শুনে সবে একটু মুষড়ে পড়তে যাব, তক্ষুণি আমাদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সেই পথেই একটা ক্রেন এসে হাজির । এই ক্রেনটিকেই আমরা কিছুক্ষণ আগে ওভারটেক করে এগিয়ে এসেছিলাম । ভাগ্য আজ পুরোপুরি আমাদের সহায় । নইলে আজ এখনই বা ওই কদাকার যানটি এই পথেই যাবেন কেন ! যাকগে, আমাদের কীর্তিকলাপ দেখে ইতিমধ্যে ক্রেনের চালক পরিস্থিতি আন্দাজ করে ফেলেছে । আমাদের পাশ কাটিয়ে তার বিকট দেহসৌষ্ঠব নিয়ে এগিয়ে গেল । কেটে চেঁচে বরফ তুলে ফেলে দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করতে আমরা আবার চলা শুরু করলাম । খানিক বাদে আবার দুচারটে মোড় ঘুরে অবশেষে এসে পড়লাম চোপতা ।
ভারতের সুইটজারল্যান্ড । যেদিকে দুচোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ । গাছের পাতার উপর চাপ চাপ ঝুরো বরফ জমে আছে । দেখে মনে হচ্ছে যেন গাছে গাছে বরফের ফুল ফুটেছে । রাস্তার ধারে বরফের ছয় সাত ফুট উঁচু প্রাচীর ঢালু হয়ে উঠে গেছে আরও উপরের দিকে । এখান থেকে তুঙ্গনাথ যাবার রাস্তা চলে গেছে । কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মদমহেশ্বর ও কল্পেশ্বর, এই হল পঞ্চকেদার । তুঙ্গনাথ হল পঞ্চকেদারের অন্যতম একটি । পর্যটকগণ গাড়ি করে চোপতা পর্যন্ত এসে ট্রেক করে তুঙ্গনাথ যেতে পারেন ।
ঘন্টাখানেক সময় কাটিয়ে, ম্যাগী সহযোগে চা খেয়ে আবার রওনা দেওয়া গেল । বেলা দ্বিপ্রহর । দিনের আলো থাকতে থাকতে যোশীমঠ পৌঁছতে পারলে খুবই ভাল হয় ।
উখিমঠ থেকে বেরোতে নটা বেজে গিয়েছিল । উখিমঠ থেকে যোশীমঠের দূরত্ব প্রায় একশো ত্রিশ কিলোমিটার । পাঁচটা নাগাদ যখন যোশীমঠ পৌঁছলাম সূর্য তখনও পাহাড়ের পিছনে মুখ লুকায়নি । আকাশে দিব্যি আলো আছে । সন্ধ্যে হতে তখনও কিছুটা সময় বাঁকি ।

১৩ই মার্চ ২০১৯
স্নান সেরে, গরম গরম লুচি আর কাবুলি ছোলার ঘুগনি খেয়ে রওনা দিলাম বহুপ্রার্থিত আরেক তুষাররাজ্য ‘আউলি’র দিকে । যোশীমঠ থেকে আউলির দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার । গাড়িতে পাহাড়ি পথে চড়াই ভেঙে উপরে উঠতে লাগলাম । আর্মি ক্যাম্প ছেড়ে যত এগোতে লাগলাম প্রকৃতি আরও রুক্ষ এবং শীতল হতে লাগলো । পথের ধারে বরফের দেখা পেতে লাগলাম । সংকীর্ণ রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে উপরে, আরও উপরে । গাড়ি থামলো স্কি রিসর্ট । এইখানে গাড়ির যাত্রা শেষ । এরপর কেবিলের মাধ্যমে উপরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা । ঝুলন্ত চেয়ারের বসিয়ে পর্যটকদের উপরে নিয়ে যাওয়া হয় । সর্বোচ্চ চারজন বসতে পারেন । মাথাপিছু যাতায়াত আজকের তারিখে ₹৫০০ । যারা এখানে স্কি করতে আসেন, মূলত তাদের জন্যেই এই ব্যবস্থা । এছাড়াও নিচে যোশীমঠ থেকে রোপওয়ে আছে পর্যটকদের ওপরে নিয়ে আসার জন্য । সর্বোচ্চ পঁচিশ জন এবং যাতায়াত মাথাপিছু ₹১১০০ (আজকের তারিখে) বিনিময়ে যাওয়া যায় তুষাররাজ্যের চূড়ায় । উভয় কেবল লিফটিংয়ের পরিচালনায় আছে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগম । সমগ্র উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন জায়গার মত এখানেও রাজ্য সরকারের গেস্ট হাউস আছে । আমরা বরফে চলার উপযুক্ত রবারের গামবুট ভাড়া নিয়ে পায়ে গলিয়ে টিকিট কেটে চেয়ার কারে গিয়ে বসলাম । চলা শুরু হতেই চেয়ার ধীরে ধীরে সামনের দিকে উপরে উঠতে লাগলো । চেয়ার যত উপরে উঠছে, বুকের ভেতর তত বেশি ধুকপুক করছে । উড়ন্ত পাখি নিচে তাকলে কেমন দেখবে তার খানিকটা আন্দাজ পাচ্ছিলাম । মিনিট পাঁচেকের সফর শেষে যখন উপরে শক্ত কংক্রিটের মেঝেতে পা রাখলাম তখনও বুকে মাদল বাজার শব্দ আর পেটের ভেতর ফড়িং-এর ওড়াউড়ি টের পাচ্ছিলাম । খানিকটা ধাতস্ত হয়ে প্রবেশ করলাম বরফরাজ্যে । উপরে টাকার বিনিময়ে স্কি করা, স্লেজ চড়ার ব্যবস্থা আছে । ছোট ছোট গুমটি দোকানে করে চা, কফি, ম্যাগী, পাকোড়া, রাজমা, চাউল ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে । দাম অবশ্যই সমতলের এবং সাধারণের থেকে বেশি । আর সেটাই স্বাভাবিক ।20190313_112704
সাগরে যেমন ঢেউয়ের পর ঢেউ জুড়ে এক অপরূপ শোভার সৃষ্টি করে এখানেও তেমন বরফের ঢেউ একের পর এক জুড়ে এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা করেছে । বিশাল ছড়ানো ভ্যালি সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা । সামনে দিগন্ত বিস্তৃত নন্দাদেবীর বিস্তীর্ণ রেঞ্জ বরফের মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে । আকাশ মেঘলা । নীলচে পর্বতের সারির ভাঁজে ভাঁজে মেঘেদের খেলা দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল । চার-পাঁচফুট পুরু বরফ, তার উপর এক-দেড়ফুটের পাতলা আস্তরণ । প্রতি পদক্ষেপে পায়ের নিচের দিকের সাত আট ইঞ্চি বরফের তলায় অদৃশ্য হচ্ছে । বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় খানিকদূর হাঁটাহাঁটি করতেই হাঁফ ধরে যাচ্ছে । ঠান্ডায় শরীরের খোলা অংশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে । এই ঠান্ডায় একটু কড়া কফি হলে মন্দ হয় না । যেমন ভাবা তেমন কাজ । ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ চলে এল হাতে । কফির উষ্ণতাটা হাতে আরাম দিচ্ছিল বেশ । পরম আয়েশে কফির পাত্রে চুমুক দিলাম ।

১৭ই মার্চ রাতের ট্রেনে কলকাতার দিকে রওনা দেবার সময়ও স্মৃতির পাতা থেকে বরফের কুচি ঝরে পড়ছিল । ফিরে এসে কলকাতার প্যাচপ্যাচে গরমের কথা ভাবলেই গায়ে যেন জ্বর আসছিল । দেবতার দেশ দেবতারা সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছে । মানুষ সেই সাজানো সংসার ভাঙছে । খোদার ওপর খোদকারি আর প্রকৃতির সাথে বাটপারির পরিণাম যে কি হবে তা সময়ই বলবে ।

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব:৯]

সকাল থেকেই একটা বিষন্নতা ছেয়ে আছে মনে । এই কয়েকদিনেই যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে সেই বাঁধন আজ ছেঁড়ার পালা । সকাল সকাল উঠে গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে । কাকাবাবু আমাদের সঙ্গে ফিরবেন না । কয়েকদিন পরে ফিরবেন । আমি, মেজ আর ছোট ফিরে আসছি । বড় দাদাবাবু আর দেবাশীষ ভোমরার বর্ডার পর্যন্ত আসবেন আমাদের এগিয়ে দিতে । শেষবারের মত পুকুরের জলে গা ভাসিয়ে দিলাম । আজ আর দাপাদাপি করার ইচ্ছে হল না । বাড়ি ফিরে খেয়ে জামাকাপড় পড়ে তৈরি হয়ে নিলাম । সারা বাড়িতেই একটা বিষণ্ণতার ছায়া । সকাল থেকেই এ-বাড়িতে লোকের মেলা । আমাদের বিদায় জানাতে বরুণ, কর্ণ, কুমারেশ, প্রলয় ও আরও অনেকে উপস্থিত হয়েছে । বড়দিদি সন্তানাদি সহ ফিরে যাবে আজকে । আমাদের সঙ্গেই রওনা হবে । আমাদের বিদায় জানাতে জড়ো হওয়া জনা পঁচিশেক নরনারীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম । গ্রাম্য সারল্য মাখা চোখগুলো যেন বলছে, ওরে যাসনে, আর কটাদিন থেকে যা । কিন্তু আমাদের সে উপায় নেই । সকলেরই টিকি কোথাও না কোথাও বাঁধা আছে । নির্জন মাঠে ঘাস খেতে খেতে গরু যেমন অনেকদূরে কোথাও চলে যেতে পারে না, খুঁটিতে টান পড়ে । তেমন আমাদেরও খুঁটিতে টান পড়েছে । আর যাওয়া যাবে না ।
আমরা রওনা হয়ে পড়লাম । পিছন পিছন পুরো দলটা আসছে । শ্রীধরপুরের মোড়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁইছুঁই । এবার সকলের থেকে বিদায় নেবার পালা । সকলের মনেই একটা বিষন্নতার মেঘ জমেছে । দেবুদার ছলছলে চোখের পানে চাইতে পারলাম না । ইতিমধ্যে দাদাবাবু একটা টোটো থুড়ি ইজি বাইক ঠিক করে ফেলেছেন । বড় দিদি আর আমরা চেপে বসলাম । বড়দি রাস্তায় নেমে যাবে । গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে । পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে নেড়ে নেড়ে শেষ বিদায় জানালাম । ঝোড়ো হাওয়ায় রুমাল উড়তে লাগলো । মনটা ভারী হয়ে গেল । এখানকার মানুষজন, মাঠ, ঘাট, ধানের ক্ষেত, শষ্যশ্যামল প্রান্তর, দিগন্ত বিস্তৃত মাছের ঘের, নীলাকাশ, ঝোড়ো হাওয়া সবকিছুকে ভীষণ মিস করবো । দেশে ফিরে আর পুকুরের জল খাব না, তিনবেলা খেতে বসলে আতপ চালের ভাতও দেবে না কেউ, কেউ হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রলয়ের দাদুর দোকানের প্রচন্ড কষ লিকার চা খাওয়াবে না, সন্ধ্যার প্রাক্কালে ধানক্ষেতের ধারে বসে রতন চানাচুর খেতে খেতে আড্ডা দেব না আর, মাঝরাতে কপোতাক্ষর শীতল হাওয়ায় ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চাদর টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শোব না, এগুলো ভাবলেই মনটা ভেজা তুলোর মত ভারী হয়ে উঠছে । দুপাশে ফাঁকা জমি, বাড়িঘর, মানুষজন পেরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত ।

রাজহাঁসের বাচ্চা কোলে . . .
সেই পুকুরপাড় . . .
ঢং করে উকুন বাছা . . .
মনে পড়বে সে দিনগুলো . . .

একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম । টোটো থামতে চমক ভাঙলো । দিদি নেমে যাচ্ছে । সকলেই নামা হল । দিদিকে ছেলেমেয়ে সমেত অন্য একটা ভ্যানে তুলে রওনা করিয়ে দিয়ে আমরা টোটোয় ফিরে এলাম । কুল্যার মোড় পৌঁছতেই বাস পেয়ে গেলাম ।  বাসে সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে চলেছি । বাস চলেছে শম্বুক গতিতে । সঙ্গে এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে অকারণ বিলম্ব তো আছেই । আজ কিন্তু ততটা খারাপ লাগছে না । মনে হচ্ছে যেন বাসটাও আমাদের চলে যাওয়াতে বিষণ্ণ । যেন খানিক্ষণ আর আটকে রাখাই বিলম্বের কারণ । কিন্তু শামুকও কখনও না কখনও গন্তব্যে পৌঁছয় । আমরাও সাতক্ষীরা পৌঁছলাম । কিছু কেনাকাটা করার ছিল । যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে ভোমরার টেম্পো ধরলাম । একেবারেই জরাজীর্ণ মৃতপ্রায় টেম্পো আমাদের নিয়ে চলল । টেম্পো আমাদের শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়েছে নাকি আমরা টেম্পার শেষ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছি বোঝা যাচ্ছিল না । সারাটা রাস্তা অনর্গল বায়ু ও শব্দদূষণ চলতে থাকলো । অবশেষে বেলা একটা নাগাদ ভোমরা পৌঁছলাম । টেম্পো থেকে নেমে আমরা হেঁটে এলাম বর্ডার পর্যন্ত । কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পেরিয়ে শেষ বিদায় জানাবার জন্য প্রস্তুত হলাম । দেবাশীষরা এর বেশি এগোতে পারবে না । আমরা কোলাকুলি করে বিদায় চাইলাম । দাদাবাবু একগাল হাসি নিয়ে বিদায় জানালেন । দাদাবাবুর ঝকঝকে উজ্জ্বল হাসির পিছনে লুকনো মনখারাপের অন্ধকারটা আমার চোখ এড়ালো না । আমরা আর দাঁড়ালাম না । খারাপ লাগাটা যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরছিল । দুদেশের মাঝের ছোট্ট খালটা পেরিয়ে একবার দাঁড়ালাম । পিছন ফিরে একবার তাকালাম । বিষণ্ণ উদাস চোখে কিছুই ভাল ঠাহর করতে পারলাম না । মাথা নীচু করে হেঁটে পেরিয়ে এলাম ‘নো ম্যানস্ ল্যান্ড’ । প্রবেশ করলাম ভারতবর্ষে ।

[সমাপ্ত]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৮]
কথা ছিল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাব মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে । কিন্তু অন্যান্য দিনের মতই আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পারলাম সে গুড়ে বালি । সকাল থেকেই এবাড়ি ওবাড়ির মহিলারা হামান দিস্তায় চাল গুঁড়ো করছে । ওবেলা পিঠে হবে । আমাদের বাড়িতে দুই দিদি আর জেঠীমা বারান্দায় বসে পর্যায়ক্রমে আতপচাল গুঁড়ো করে চলেছে । একজনের হাত ব্যাথা হয়ে গেলে আরেকজন করে । আমি গিয়ে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম । হামান দিস্তায় চাল পিষতে গিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গলদ ঘর্ম অবস্থায় রণে ভঙ্গ দিলাম ।

বেলা দশটা নাগাদ স্নান করতে গেলাম । অপর্ণাদি আর তুষারদা ফিরে যাবে আজ । একই রাস্তায় যাওয়া হবে, তাই একসাথে রওনা হবো ঠিক হয়েছে । সব গোছগাছ করে বেরোতে বেলা বারটা বেজে গেল । কখন পৌঁছব কে জানে ! বড় রাস্তায় উঠতেই একটা ভ্যান পেয়ে গেলাম । ছেলেটি মুসলমান । বাড়ি এই গ্রামেরই ওমাথায় । আমরা উঠে বসলাম । আমি, মেজ, ছোট, কাকাবাবু, তুষারদা, অপর্ণাদি আর ওদের ছোট্ট মেয়ে । মোটামুটি সাড়ে ছয়জন । মটর চালিত ভ্যান ছুটেছে সাঁ সাঁ শব্দ করে । প্রচন্ড হাওয়ায় চোখ মেলা যাচ্ছে না । চালকের বয়স বেশি নয় । যেতে যেতে জানা গেল ভ্যানচালকের বাবা কাকাবাবুর ছোটবেলার বন্ধু । গল্প করতে করতে হলদিপোতা, যদুরডাঙা পেরিয়ে এসেছি । একজায়গায় নেমে পড়লাম । ছেলেটি আর যাবে না ।

ব্রিজের ওপর

 

 ব্রিজের ওপর থেকে . . . .

 

এখান থেকে ভ্যান বদলাতে হবে । অন্য ভ্যানে গোয়ালডাঙা বাজারে এসে যখন নামলাম তখন বেলা একটা বাজতে যায় । তুষারদা আবদার করে বসলো এখানকার স্পেশাল দই না খেয়ে যাওয়া যাবে না । আমাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকে এক হাঁড়ি মিষ্টি দই অর্ডার দিয়ে ফ্যানের তলায় টেবিলে গিয়ে বসলেন । আমরাও চুপচাপ ঢুকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম । দোকানদার তুষারদার চেনা । একহাঁড়ি দই ছোট প্লেটে ভাগ করে সকলকে দিল । ইচ্ছে না থাকলেও এক চামচ দই মুখে পুরে দিলাম । পরক্ষণে মনের মধ্যে যে অনূভুতিটা হল, তা ‘অপূর্ব’ । নামে মিষ্টি দই হলেও বস্তুটি আদতে টক-মিষ্টি এবং এই গরমে পরম উপাদেয় । চেটেপুটে প্লেট শেষ করে বেরিয়ে এলাম । এখান থেকে তুষারদা সপরিবারে গৃহাভিমুখে যাত্রা করবে । এখান থেকেই ঘটবে আমাদের বিচ্ছেদ । তুষারদা আমাদের অন্য একটা ভ্যানে তুলে রওনা করিয়ে দিল । চলন্ত ভ্যান থেকে আমরা হাত নেড়ে বিদায় জানালাম । মোড়ের মাথায় ভ্যান বাঁক না নেওয়া পর্যন্ত ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।
চড়া রোদে মাঠের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলেছি । বেলা প্রায় দুটোর কাছাকাছি আমরা শ্যামল মামার গৃহের প্রান্তে ভ্যান থেকে নামলাম । গরমে দুপুরের রোদে প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে ।

 

 শ্যামল মামা

 

শ্যামল মামা মেজর দূর সম্পর্কের মামা হন । তবে ভালবাসায় নিজের আত্মীয়ের থেকেও বেশি । গ্রামেরই প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন । মামী একই স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে । দুই ছেলেসহ সুখের সংসার । অমায়িক ব্যবহার । অজ গাঁয়ে শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল পরিবার দেখে বড় ভাল লাগলো । মেজর তিন মামা পাশেই থাকে । ছোট ভ্যান থেকে নেমেই চলে গেছে দেখা করতে । আমরাও একটু মুখ দেখিয়ে এলাম । মামী রান্না করছেন । শ্যামল মামা আমাদের আদর আপ্যায়নের তদারকি করছেন । আমি আর মেজ হাতমুখ ধুয়ে টেবিল ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসলাম । পরমুহূর্তেই মেজ গুলি খাওয়া সৈনিকের মত বিছানায় লুটিয়ে পড়লো । নাড়া দিয়ে বুঝলাম ঘুমে তলিয়ে গেছে । অদ্ভুত প্রতিভা । এই মুহুর্তে কথা বলছে, পরমুহূর্তেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । ক্লান্তির দরুণ আমারও ঝিমুনি আসছিল । মেজর পাশে আমিও বডি ফেললাম । খানিক পরে মামার ডাকাডাকিতে তন্দ্রা কেটে গেল । চোখমুখে জল দিয়ে খেতে বসলাম । ঝুরঝুরে ভাত, আলু দিয়ে উচ্ছে ভাজা, কাঁচকলা দিয়ে রুই মাছ আর দিশি মুরগির ঝোল এবং সর্বপরি দাম দিয়ে কেনা ফিল্টারের জল । মামার রুচি আর মামীর অপূর্ব রান্নার প্রশংসা না করে পারলাম না ।

 

 মামী (শ্যামল মামার স্ত্রী)

শেষপাতে দইটা কোনক্রমে খেয়ে আবার বিছানায় গিয়ে উঠলাম । মামা স্কুলের সময় ছাড়া বাড়িতে সকাল বিকাল টিউশন পড়ান । বিকেলের ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা আসতে আরম্ভ করেছে । মামা পড়াতে বসলেন । আমরা আরেকটু গড়াগড়ি দিয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম । শত বাধা সত্ত্বেও বিদায় চেয়ে নিয়ে মেজর আপন মামাদের ভিটেয় গেলাম বিদায় চাইতে ।

সেকাল ও একাল
 দিদা ও ভাইয়ের সঙ্গে মেজ

একবেলাও না খাওয়ায় মনক্ষুন্ন হয়েছে ওরা । আমরা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানালাম হাতে সময় অত্যন্ত কম । পরেরবার সব হবে । মেজ মামা ছেলেকে গাছে তুলে দিল ডাব পাড়ার জন্য ।

 কচি ডাবের জলে তৃষ্ণা নিবারণ

আমরা ডাবের জল, কাঁচা গরুর দুধ আর বাতাসা খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম ।
এখান থেকে ভ্যান পাবার কোন সম্ভাবনা নেই । অতএব দুটি পা-ই ভরসা । হাঁটা শুরু করলাম । কিছুদূর গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়লাম । শীতের ধান কাটা হয়ে গেছে । বিশাল ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা একটা পায়ে চলা পথ দিগন্তে গিয়ে মিশেছে । সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে সবে । গোধূলির রং এখনো আকাশে ছেয়ে আছে । দূরে একদিকে নির্দেশ করে কাকাবাবু বললেন আমরা ওইখানে যাব । কাকাবাবুর নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে বহুদূরে বিন্দুর মত একটা বাড়ির টিনের চাল চোখে পড়লো । এখন এই ভরা পেটে এতদূর হাঁটতে হবে ভেবেই চোখে জল আসছিল । এদিকে মেজ আমায় আস্তে আস্তে জানাল ওর পেটে গুড়গুড় মাদল বাজছে । প্রকৃতির মায়াবী ডাক কতক্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারবে তা জানে না । ভেবে দেখলাম আমার থেকে ওর সমস্যাটা অনেক বড় ।

চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম । একসময় দিগন্তে এসে পৌঁছলাম । একটা ছোট্ট নদী (এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে), তার উপর দিয়ে একটা নৌকো আড়াআড়িভাবে রাখা । আমরা নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে পাড়ানির(খেয়া পারাপারের) কড়ি ফেললাম । এতক্ষণে ভ্যানের দেখা পেলাম । মেজর মুখ দেখে ওর অবস্থাটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম । মেজ ওর নিন্মগামী বেগ আর বেশিক্ষণ সামলাতে পারবে না বুঝতে পারছি । আমি ওকে নানা গল্প বলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি । যদিও আমার গল্প ওর অন্তঃকর্ণে আদৌ প্রবেশ করছে কিনা বোঝা গেল না । অবশেষে সন্ধ্যে গাড় হবার মুখে বাড়ি এসে পৌঁছলাম । মেজ ভ্যান থেকে নেমেই দৌড় দিল । ছোটও ওর বন্ধুদের দেখতে পেয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল । আমি আর কাকাবাবু ভাড়া মিটিয়ে বাড়ি এসে ঢুকলাম ।

বাড়িতে পিঠে তৈরি হচ্ছে । ঘরে গিয়ে শুনলাম মেজ জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে আমাদের এবেলা নেমন্তন্ন । মেজ জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে উঁকি দিতেই আমাদের টেনে নিয়ে বসাল । হাতে হাতে প্লেট চলে এলো । প্লেটে দুরকম পিঠে আর পায়েস । ওবেলার গুরুভোজনের ফলে পেটে এমনিতেই জায়গা নেই, তার উপরে মিষ্টান্ন । কোনরকমে পেটে চালান করলাম । একটু পরেই আবার রাতের খাওয়ার সময় হয়ে যাবে । পেটের কোন অংশে কতটুকু ভরবো সেই জায়গা করতে লাগলাম । আগামীকাল লোটাকম্বলসহ প্রস্থান করবো । আজ অষ্টম দিন বাংলাদেশের মাটিতে আমাদের ঘিরে সন্ধ্যে নামলো । আগামীকাল সন্ধ্যে হয়তো কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে নামবে । স্ট্রীট লাইটের আলোয় বড়ই ফিকে সে সন্ধ্যে । তার ঘনত্ব চোখে লাগে না । এখানে সন্ধ্যে নামারও যেন একটা শব্দ আছে । ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতানে আপ্যায়িত হয়ে সন্ধ্যে আসে সদলবলে । কলকাতার সন্ধ্যের শব্দ ঢেকে যায় মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে ।

রাতে মাংস দিয়ে অল্প করে ভাত এবং তৎসহ আরেকপ্রস্থ পিঠেপুলি সাবাড় করে শুতে গেলাম । কাল সকাল সকাল উঠতে হবে । নইলে পথে দেরি হয়ে যেতে পারে ।

(চলবে . . .)


[আগামীপর্ব অর্থাৎ শেষপর্ব আগামী বুধবার]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৭]


ঘুম ভাঙতে শুনলাম আজ বিসর্জন । বিকেলের দিকে হবে হয়তো । কলকাতায় পুজো মানে যা, এখানে ঠিক তা নয় । ওখানে বিসর্জনেরও আবহ থাকে সরগরম । কিন্তু এখানে সেরকম কিছুই না । লোকজন নিজেদের নিত্যনৈমত্তিক কাজে ব্যাস্ত । বেশি মাতামাতি নেই কোন ব্যাপারে । আমরা প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম । একটু ফাঁকা পেতে কাকাবাবুকে নিয়ে বসা গেল । মামার বাড়ি ঘুরে এসে দেশে ফেরার কি পরিকল্পনা আছে জানতে চাইলাম । জানা গেল আজকেই জেলপুত-এ মামার বাড়ি যাওয়া হত, কিন্তু এবাড়িতে অতিথীদের অনারে আজ ভেড়া কাটা হবে, তাই আজ কোথাও যাবার উপায় নেই । দেবুদা সকাল থেকেই ব্যাস্ত । দাদাবাবুরা বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে তাস পেটাচ্ছে । আমরা কখনো তাসের আড্ডায় কখনো রাস্তার ধারে ।

অবলা প্রাণীগুলো

একটু বেলা হতে দেবুদা অবলা প্রাণীটিকে এনে হাজির করলো । আমার মনে তখন নানা রিপুর সংমিশ্রণ । বেচারা প্রাণীটা জবাই হতে চলেছে সেটা মেনে নিতে পারছি না । আবার খাদ্যদ্রব্য হিসেবে তার সুস্বাদের খ্যাতি জেনে তা প্রত্যাখানও করতে পারছি না । তবে প্রাণীটির সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে এটা বুঝেও আমি কিছুই করতে পারছি না দেখে সামনে উপস্থিত না থাকাই শ্রেয় মনে করলাম । আর এমন নৃশংস কার্যকলাপের সম্মুখে থাকা আমি বরাবরই পছন্দ করি না । অবশ্য মেজর তৈরি করা ভিডিওতে সেই নৃশংসতার পরিচয় পেয়েছিলাম । মুন্ডু কেটে প্রাণীটির পিছনের পা দুটো উপরে করে সবেদা গাছের ডালে বেঁধে নিপুণ দক্ষতায় কাকাবাবু ছাল ছাড়িয়ে কিভাবে কেটেছিলেন, সব পরিষ্কার কুমারেশের দক্ষ সিনেমাটোগ্রাফিতে ।

আমি অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে পারিনি সে ভিডিও । এদিকে মেঘে মেঘে বেলা হয়েছে ভালই । আমরা আমাদের কাজ থুড়ি অকাজ মুলতুবি রেখে স্নান করতে গেলাম ।দুপুরে খেতে বসার সময় লোকের মেলা । আমরা ছাড়াও বেশ কিছু নিমন্ত্রিত । বারান্দায় সারি দিয়ে খেতে বসলাম । নিরামিষ ডাল, তরকারির পর অবশেষে সকলের কাঙ্খিত বস্তুটি এলো বড় এক গামলায় চড়ে । আহা কি তার রং ! যেন গোলাপবাগের গোলাপ । কি তার ঘনত্ব ! যেন ভরা পৌষের খেজুরের রস । কি তার সুগন্ধ ! যেন বিরিয়ানীর আতর । ঝোলসহ মাংসের টুকরোগুলো পাতে পড়তেই আঙুলগুলো ভাত আর ঝোলের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য উসখুস করতে লাগলো । যেন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা । বিয়ের বয়সী মেয়ের হাত কোন সুপাত্রের হাতে দিতে পারলে বর্তে যায় । ভাত মাখিয়ে পরম সুখে এক গ্রাস মুখে তুললাম । সুখ মুহুর্তেই অসুখে রূপান্তরিত হল । এক গ্রাস ঝোল মিশ্রিত ভাত মুখে দিতেই অনুভব করলাম যেন জ্বলন্ত অঙ্গার মুখে নিয়েছি । গালে এবং কানে ঈষৎ লাল আভা ফুটে উঠলো । লজ্জায় নয়, ঝালে । কড়া মদ গিলে ফেললে খাদ্যনালী যেমন জ্বালা জ্বালা করে, তেমন জ্বালা অনুভব করলাম । কোনমতে চোখের জল ধরে রেখে অন্যদের দিকে চাইলাম । মুখ দেখে বোঝা গেল সকলেরই প্রায় একই অবস্থা ।

ভেড়ার মাংস ভক্ষণ

চোখমুখ লাল, কপালে ও নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে । ইষ্টদেবতার নাম জপ করে আরেকগ্রাস মুখে দিলাম । চোখের জল আর বাঁধ মানলো না । বারিধারা বয়ে চলল গাল বেয়ে । আমার ডানপাশে দেবাশীষ আর বামপাশে তুষার দাদাবাবু । দুজনেই কাহিল, রণক্লান্ত । মাঝে মাঝে চাপা গোঙানির মত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । আগামীকালের প্রাতঃকৃত্যের কথা মনে পড়তেই প্রমাদ গুনলাম । খানিক ধস্তাধস্তি করে তুষারদা হাল ছেড়ে দিল । মাংসের টুকরোগুলো খুঁটে খেয়ে পাতে জল ঢেলে উঠে গেল । বাকিরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম । অবশেষে কয়েককিলো এক্সট্রা অক্সিজেন ধ্বংস করে খাওয়া শেষ করলাম । শেষ পাতে অবশ্য টমেটোর চাটনি ছিল । কিন্তু তার উপর ভাসমান শুকনো লংকার বহর দেখে সাহসে কুলালো না । সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে হাঁপাতে লাগলাম । ঘন্টাখানেক পরে একটু ধাতস্থ হওয়া গেল । মাংসের এত ঝালের রহস্য কি জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম শুকনো লংকা, কাঁচা লংকা ও গোলমরিচ বেটে তার সঙ্গে চুঁইয়ের ডাঁটা টুকরো করে ঝোলে দেওয়া হয়েছে । কিন্তু পরিমাণটা একটু বেশি হয়ে যাওয়াতেই এই বিপত্তি ।
খানিক বিশ্রাম নিয়ে দেবুদা আমাদের ওর ধানক্ষেত দেখাতে নিয়ে চলল । আমি, মেজ আর কাকাবাবু দেবুদার সঙ্গে চলেছি ।

টুকটুকে টমেটো

আল ধরে যেতে যেতে আমি আর মেজ টমেটো গাছে ঝুলে থাকা লাল টুকটুকে টমেটো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুড়ছি । দেবুদা নতুন এক ধরনের ছত্রাকের উৎপত্তির কথা বলছিল, যা ধানের খুব ক্ষতি করছে এবছর । অথচ তার ওষুধ কারোর জানা নেই । দুজন কৃষক আত্মহত্যা করেছে বলেও শুনলাম । মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের দেশে সরকারী নীতির (বলা ভাল দুর্নীতির) কোপে বহু কৃষক আত্মহত্যা করছে । সে তুলনায় এটা নিতান্তই কম । কিন্তু সংখ্যা কম হলেই তার গুরুত্ব কমে যায় না ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেবুদার জমিতে এসে পড়লাম । ওর ধানেও কয়েকজায়গায় অল্প করে সেই অজ্ঞাত ছত্রাকের আক্রমণ হয়েছে । সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ধান কাটার মত হয়ে যাবে । তদ্দিন থাকলে হয় !

আমরা ফিরে এলাম । বাড়িতে এসে দেখি কর্ণ, বরুণ ও আরও কয়েকজন আমাদের খুঁজছে । ব্যাপার কি ! শুনলাম শ্মশানের ধারে বিশাল মাঠ, সেখানে ফুটবল খেলা হবে । এক্ষুনি যেন লুঙ্গি ছেড়ে হাফ প্যান্ট পড়ে হাজির হই । আমি আর মেজ হাফ প্যান্ট পড়ে নিলাম । সৈকত কলকাতায় ‘বিধাননগর স্পোর্টস একডেমী’র জুনিয়র গ্রুপে খেলে । ফলে ওর উৎসাহ আরও বেশি । মাঠে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য । খেলা শুরু হয়ে গেছে । আমরা ভাগাভাগি হয়ে গেলাম । কে কোন দলে জায়গা পেলাম, কে কোনদিকে গোল দেবে, কারা আত্মপক্ষ কারাই বা বিরুদ্ধপক্ষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না । সবাই দৌড়াচ্ছে নিজের আনন্দে । সেরকমই এক দৌড়বীরকে জিজ্ঞেস করায় সে উত্তর দিল পায়ে বল পেলে যে গোল কাছে পাবে সেই গোলে মার । যেদিকেই হোক গোল হলেই হল । জবাব শুনে দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে সাহস করলাম না । একটু পরে আমার স্থান হল একদিকের গোলে । তিনদিকে ধানক্ষেত আর একদিকে পুকুর দিয়ে ঘেরা মাঠে গোলকিপারের পদ সামলাচ্ছি । খেলা দেখে মনে হচ্ছিলো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বেধেছে । সৈকত খুব একটা জুত করতে পারছে না । এ ওর শেখা শহুরে মার্জিত খেলা নয় । এ হল বন্য ক্রীড়া । কারোর পায়ে বল গেলে সকলে ছুটে যাচ্ছে তার ঠ্যাং ভাঙতে । বল মিস হয় হোক, পা যেন মিস না হয় । কিছুক্ষণ এই বিপজ্জনক খেলা পর্যবেক্ষণ করে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম । এদিকে আকাশে গোধূলির ম্লান আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে । মানে মানে গোল ছেড়ে পালাবো কিনা চিন্তা করছি এমন সময় কোন এক মারাদোনার দুরন্ত শটে বল আমার মাথার উপর দিয়ে গিয়ে পিছনের বুক সমান উঁচু ধানক্ষেতে পড়লো এবং সাথে সাথে খেলার পরিসমাপ্তি ঘটলো । বল খুঁজে বের করে নিয়ে বাড়ি এসে পুকুরে ভাল করে গা ধুয়ে নিলাম ।

ক্রমে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল । বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে খেতে গেলাম । কাল সকাল সকাল উঠতে হবে । জেলপুতে মামার বাড়ি যাব ।

(চলবে . . .)



[পরের পর্ব অর্থাৎ পর্ব:৮ আগামী বুধবার]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৬]

ঘুম ভাঙতে দেখি প্রলয় এসে বসে আছে । ওর বাড়িতে আমাদের নাস্তার আমন্ত্রণ । আমাদের নিয়ে যাবার জন্য এসেছে । গতকাল দুজায়গায় খেয়ে ওদের ওখানে যাবার আর সময় হয়নি । অতএব সকালে । আমরা মুখ ধুয়ে চললাম । প্রলয় এখানে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে । ওর দিদা ওকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে । প্রলয়ের দাদুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আগেই । এবারে আলাপ হল দিদার সঙ্গে । বয়স হয়ে গেলেও শাররীক দুর্বলতা ভদ্রমহিলাকে বিন্দুমাত্র গ্রাস করেনি । পান খেয়ে সর্বক্ষণ ঠোঁট লাল । প্রলয়ের মামাদের বয়স খুব বেশি নয় । তাদের সব আলাদা সংসার । প্রলয়ের দিদা মজার মানুষ । জোয়ান ছেলেদের সঙ্গে রসিকতা করতে পছন্দ করেন । তার রঙ্গ-রসিকতার মধ্যে অবশ্য একটু আদিরসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । আপাত নিরীহ দাদু আর ফাজিল দিদার তত্বাবধানে প্রলয় যে বেশ রসিক হয়ে উঠছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না ।

খাওয়া সেরে বিদায় নিয়ে বাড়ি গিয়ে দেখি জ্যাঠামশাই মাছ ধরতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । আগে একদিন মেজ সঙ্গে গিয়েছিল । আজ আমিও নিমন্ত্রিত । সৈকতও বিনা নিমন্ত্রণে এসে হাজির । আমার পরনে একটা গামছা, হাতে বালতি । মেজ গামছা পড়েছে । সৈকত অন্তর্বাসেই প্রস্তুত । বেচারার একখানা গামছাও জোটেনি । জ্যাঠার হাতে জাল । হাটখোলা বাজারের পিছনে ছোট্ট ডোবার মধ্যে গিয়ে নামলাম । প্রথমেই আঁশটে গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠলো । মেজ আশ্বস্ত করলো যে একটু পরে সয়ে যাবে । জ্যাঠা আমাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন । আমাদের কাজ হল ডোবার পরিধি বরাবর জলের তলায় মাটির দেয়ালের গর্তে হাত ভরে দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে থাকা মাছ ধরে আনা অথবা বের করে দেওয়া । এরপর জ্যাঠা জাল ফেলবেন, তাহলে অনেক মাছ উঠবে । আমরা কোমর সমান জলে ঢেউ তুলে অতীব তৎপরতার সঙ্গে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে লাগলাম । প্রচন্ড দাপাদাপি করে জল ঘুলিয়ে সারা গা ভিজিয়ে যখন ডাঙায় উঠলাম, সঙ্গের বালতিতে তখন খানতিনেক মাগুর, সরপুঁটি আর বেশ কিছু তেলাপিয়া ।

হাত দিয়ে ধরা সরপুঁটি

মাছ নিয়ে ফিরে এলাম । সারা গা আঁশটে গন্ধে ম ম করছে । সাবান-ছোবড়া আর শ্যাম্পুর পাতা নিয়ে পুকুরে চললাম । অত সকাল সকাল পুকুরে লোকজন নেই । অতএব নিষেধ করারও কেউ নেই । এই সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ।

স্নানপর্ব

সারা গায়ে সাবান আর মাথায় শ্যাম্পু মেখে, কাপড় কাচার ন্যায় নিজেকে প্রায় কেচে নিয়ে পুকুরের জলে গা ভাসিয়ে দিলাম । আমার সাঁতার দেবার বিফল চেষ্টা দেখে মেজ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসছিল । কখনো বা নিজে জলের উপর একচক্কর কেটে এসে আমাকে উৎসাহ দিতে লাগলো । কিন্তু পুকুরের পরিধি বরাবর চারকদম গিয়ে আবার ঘাটে ফিরে আসতেই আমার জিভ বেরিয়ে গেল ।

পুকুরে দাপাদাপি

বুক হাপরের মত ওঠানামা করছে । ঘন্টা দুয়েক পুকুরের জলে ঝড় তুলে, লোকজন আসতে শুরু হবার আগে আগেই কেটে পড়লাম ।
বাড়ি ফিরে দেখি রান্না প্রায় শেষের পথে । বড়দাদাবাবু বিকেলে বাঁকার হাট থেকে ‘প্যারিস’ নামক কোন একপ্রকার মুরগী আনার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছে । সেটা কি জাতীয় মুরগী জিজ্ঞেস করতে সঙ্গে গেলেই দেখতে পাবো জানিয়ে ব্যাপারটা রহস্যময় করে তুললো । মনের কোণে একটু কৌতুহল রয়েই গেল । ক্রমে ক্রমে দুপুর এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল । বিকেলের সূর্য পশ্চিমে রওনা হতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম । বড়জ্যাঠামশাইয়ের দুই জামাই আর মেজজ্যাঠামশাইয়ের এক জামাই অর্থাৎ তিন জামাই, মেজ আর আমি ।

জাতীয় পোশাক লুঙ্গি

ধানজমির আল দিয়ে মাঠের মাঝামাঝি হাঁটা রাস্তা ধরলাম । লুঙ্গি পড়ে হাঁটতে গিয়ে মেয়েদের শাড়ি পড়ে হাঁটার সমস্যাটা উপলব্ধি করছি । গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছি । দুপাশে অবারিত ধানক্ষেত ।

লুঙ্গিতে কুমারেশ
পথের ধারে কচুরিপানার ফুল

কোথাও পুকুর । কপোতাক্ষর ধারে শ্মশানকে পাশ কাটিয়ে গ্রামের বাইরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি । একসময় বাজারে পৌঁছলাম । মেঠো রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে দেখি স্বপন খুড়ো মোটরবাইক নিয়ে উপস্থিত । পিছনে বসে মিহির । স্বপনের পিতৃদেব মেজর দাদা হয়, সেই সূত্রে আমারও । ফলে আমি স্বপনের কাকা অর্থাৎ খুড়ো । তাই আমরা পরস্পরকে খুড়ো বলেই সম্বোধন করি । মিহির আমার বন্ধু অশোকের (মেজর বড় দাদা) স্কুলের সহপাঠী । ওরা এইসময়ে বাজারে কেন বোঝা গেল না, কিন্তু সুবিধা হল বিস্তর । ওদের কাজ মিটলে ব্রিজের উপর দাঁড়াতে বলে আমরা কসাইখানার দিকে এগোলাম । দোকানে ঢুকে আমার চোখ তো ছানাবড়া । এই তবে ‘প্যারিস’ ! এক একটা মুরগির ওজন কমপক্ষে ছয় থেকে সাতকিলো হবে । আমরা যে ব্রয়লার খাই তা এর কাছে নিতান্তই শিশু । এর দানবিক আকৃতি দর্শন করে আমি আবার দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালাম ।

‘নসিমন’-এ বসে খানিক বিশ্রাম

ভিতরে দরদাম করে গোটা একটা মুরগী একটা ইয়া বড় ব্যাগে ভরে আমরা রওনা দিলাম । স্বপন আর মিহির দাঁড়িয়ে ছিল ব্রিজে ওঠার মুখে । আমরা মুরগির থলিটা ওর বাইকের পিছনে ঝুলিয়ে ওদের কেনা পেঁয়াজির ভাগ নিয়ে ওদেরকে বাড়ির পথে রওনা করিয়ে দিলাম । সঙ্গে এও বলে দিলাম যে আমাদের আসতে দেরি হবে এটা যেন বাড়িতে বলে দেয় । তেলেভাজা খেয়ে ওদের যেন নেশা লেগে গিয়েছিল । বড়দাদাবাবু আমাদের বগলদাবা করে আগেরদিনের সেই তেলেভাজার দোকানে গিয়ে ঢুকলেন । দুটো করে বেগুনী আর একটা করে ডিমের ডেভিল অর্ডার দিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম । দোকানে ফিল্টারের জল দেখে আগে প্রাণ ভরে জল খেয়ে নিলাম । এতদিন পুকুরের জল বলে কম কম পান করছিলাম । ছোট ছোট প্লেটে স্যালাড সহযোগে তেলেভাজা এসে উপস্থিত । চুপচুপে পদার্থগুলো গলাধঃকরণ করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম । এবার দাদাবাবু আমাদের নিয়ে মিষ্টির দোকানে ঢুকলেন । আমি আগেই মিষ্টি খাব না বলে আত্মসমর্পণ করলাম । কিন্তু আমার আবেদন প্রথমেই খারিজ হয়ে গেল । মিষ্টি আমাকে খেতেই হবে । দাদাবাবু আশ্বস্ত করলেন যে ভালো মিষ্টি, খেলেই বুঝতে পারব । আমি আর কথা বাড়ালাম না । একটু পরে আগের মতই ছোট প্লেটে ঠান্ডা দুধের মধ্যে ডুবুডুবু রসমালাই আসলো । তখন মনে হল আপত্তি করে ভুল করছিলাম । রসমালাই শত্রুর কাছেও খাওয়া যায় । কোন কথা না বলে গোগ্রাসে প্লেট খালি করলাম । দাদাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ভালো ? আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম । এরপর বাজারে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে খেয়াল হল যে বাড়ির জন্য ভাজাভুজি কিছু নিলে ভালো হত । একটা দোকানে প্রায় খান তিরিশেক তেলেভাজা দিতে বলে ওরা পান খেতে গেল । আমাকে নিতে বলাতে আমি মিষ্টি পান নেওয়া ঠিক মনে করলাম । পানে আমার কোন আসক্তি নেই । মাঝে মাঝে একটু শখ করে খাওয়া, এই আর কি ।

মিঠা পান মুখে

কিন্তু পান সাজার অবস্থা দেখে আমার মোটেই ভালো লাগলো না । একটা পাতায় চুন লাগিয়ে দু-তিন টুকরো কাঁচা সুপুরি দিয়ে আমাকে এগিয়ে দিল । সঙ্গে একটা ছোট সাদা কৌটো । আমাকে বললো যতটা মিষ্টি ইচ্ছে ঢেলে নিতে । আমি প্রথমে বুঝেই উঠতে পারলাম না মিষ্টি ঢেলে নেব মানেটা কি ! কলকাতায় অনন্ত আট-দশ রকমের মিষ্টি বস্তু, সুচারুভাবে কাটা ভাজা সুপুরি, এলাচ, চবনবাহার, আতর সহযোগে যে অমৃতসম পান আমরা খেয়ে থাকি তার সঙ্গে এর তুলনা করা মানে পানের মক্কা বেনারসের অপমান করা । এটা আর যাই হোক, মিষ্টি পান নয় । সাদা কৌটো খুলে উপুড় করতে একধরনের লাল গুঁড়ো বেরিয়ে এলো । বস্তুটা ঠিক কি তা বোঝা গেল না । অল্প করে নিয়ে পান মুড়ে মুখে ভরলাম । খানিক চিবোতে জিভটা জ্বালা করতে লাগলো ।
অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার কিছু পরে আমরা বাড়ির পথে রওনা দিলাম । যে রাস্তায় এসেছিলাম, সেই রাস্তা ধরেই ফিরছি । গাছপালার আড়াল থেকে খোলা আকাশের নীচে এসে পড়তেই অন্ধকার খানিকটা ফিকে হয়ে এলো । গল্প করতে করতে হাঁটছি । হঠাৎ বড়দাদাবাবু আমাদের থামিয়ে আলো জ্বালাতে বললেন । মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দেখি একটা সাপ হেলেদুলে রাস্তা পার হচ্ছে ।

বড়দাদাবাবুর হাতে নিগৃহীত সাপমশাই

এই অন্ধকারেও দাদাবাবু কিভাবে দেখতে পেল তাই ভাবছি, এমনসময় আমাদের চমকে দিয়ে দাদাবাবু সাপের লেজটা খপ করে ধরে বনবন করে ঘুরিয়ে ধানক্ষেতে ছুড়ে ফেলল । আমরা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম । দাদাবাবু বললেন ওই সাপের বিষ নেই । বিষ না থাকলেও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে আকাশে উড়িয়ে দেবার কি দরকার ছিল বুঝলাম না । বেচারা এখন অন্ধকারে ধানক্ষেতে কোথায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে কে জানে ! আমরা মুখে আর কিছু না বলে বাড়ির পথে এগোলাম । ধানক্ষেতের আল দিয়ে এসে হাটখোলার বাজারের পিছনদিক থেকে উঠে অবদার রাস্তা টপকে বাড়ি এসে যখন পৌঁছলাম তখন আটটা বেজে গেছে ।
রাত্রে ঝাল ঝাল ‘প্যারিস’-এর ঝোল আর ভাত দিয়ে নৈশভোজ সারলাম । ‘প্যারিস’ মুরগী খানিকটা হাঁসের মাংসের মত, শক্ত, ছিবড়ে জাতীয় । হাড় চিবোতে যাওয়া রীতিমত দুঃসাহসিক কাজ । রাস্তার উপর বসার জায়গায় গিয়ে বসলাম । ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায় । কলকাতায় এমন হাওয়া কল্পনাও করা যায় না । আমি ধীরে ধীরে বাড়ি ফেরার ব্যাপারটা কুমারেশকে(মেজ) চিন্তা করতে বললাম । এসে পর্যন্ত সৈকতের(ছোট) দেখা কমই পেয়েছি । কাকাবাবুরও আপাতত ফেরার কোন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হচ্ছে না । আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী সাতদিনের মেয়াদ প্রায় শেষ । আজ ষষ্ঠ দিন । কাল অথবা পরশু ফিরতেই হবে । মেজ সেই ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলবে জানাল । এদিকে আসার সময় অশোক বারবার বলে দিয়েছে আর কোথাও যাই না যাই মামার বাড়ি যেন অবশ্যই যাই । কাকাবাবুও আসার পর আমাকে আর মেজকে সময় করে ঘুরে আসতে বলেছে । পুজোরদিন শ্যামল মামা এসেছিলেন বাজনের দলের সাথে । তিনি যেতে বলে গেছেন । এইবার সময়াভাব অনুভব করলাম । দেখা যাক, আগামীকাল কাকাবাবু কোন সমাধানসূত্র বের করতে পারেন কিনা । ঠান্ডা হাওয়ায় ঘুম ঘুম পাচ্ছে । ফেরার চিন্তা আপাতত দূরে ঠেলে চোখে আঠালো ঘুম নিয়ে মশারির ভিতরে এসে ঢুকলাম ।

(চলবে . . .)

[পরের পর্ব অর্থাৎ পর্ব:৭ আগামী বুধবার ]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

​[পর্ব : ৫]
ঘুম ভাঙলো কচিকাঁচাদের কলরবে । সকাল থেকেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেছে ওদের । হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোলাম । আজ সকাল থেকেই একটা সাজসাজ রব । বাড়িতে একটা নিমন্ত্রণ খাওয়ানোর আবহ । ব্যাপার কি ! জিজ্ঞেস করে জানলাম, আজ সকাল থেকে কবিগান শুরু হবে । সেই আসরে উপস্থিত দূর-দূরান্ত থেকে আসা সকল শ্রোতা কোন না কোন বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন সারবেন । কেউ যেন অভুক্ত না থাকেন । এটাই এই গ্রামের এই উৎসবের নিয়ম স্বরূপ । বরং কে কতজন লোক আসর থেকে ধরে বাড়িতে খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা চলে গ্রামের লোকেদের মধ্যে । প্রত্যেক বাড়িতেই ভালোমন্দ রান্না চলছে সকাল থেকেই । ওবাড়ি থেকে দেবাশীষ এসে আমাদের বলে গেল দুপুরে ওদের বাড়িতে আমাদের খাওয়া-দাওয়া । ওর বাবা (জ্যাঠামশাই) যশোর গিয়েছিলেন মাদুর বিক্রি করতে । গতকালই ফিরেছেন । আমরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালাম ।

বেলা এগারোটা নাগাদ কবিগান শুরু হল । পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে দিই এ কবিগান সেই অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির যুগের কবিগান নয় । তখন যুযুধান দুই পক্ষ মুখোমুখি কবিতার লড়াইয়ে লিপ্ত হতেন । কবিগান প্রধানত দেব-দেবীর বন্দনা । তবে এতে মানুষের জীবনের কথাও থাকে । শুরু হত ‘বন্দনা’ দিয়ে । তারপর ধাপে ধাপে ‘সখী সংবাদ’, ‘বিরহ’, ‘খেউড়’ এবং শেষে ‘লহর’ অংশ আসত । এই ‘লহর’ অংশটিই প্রধান উপভোগ্য অংশ ছিল । এইসময় তারা ব্যক্তিগত আক্রমণে উদ্ধত হতেন । কিন্তু সবই ছন্দ মিলিয়ে গানের মাধ্যমে । তখনকার দিনের ‘ভোলা ময়রা’র মত কবিয়াল কবিগানকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন । এখনকার কবিগানে দুইপক্ষ থাকে বটে, তবে তারা কোন কবিতা মুখেমুখে তৈরি করেন না । মুখস্ত করা কোন ভক্তিগীত সুর করে আউড়ে যাওয়াই এখনকার কবিয়ালের রেওয়াজ ।

আমরা আসরের এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম । কবিমশাইয়ের উচ্চতা বেশি না হলেও বাবরি চুল আর রঙচঙে ধুতি-পাঞ্জাবিতে বেশ লাগছেন । মেলার মাঠের মাঝামাঝি উঁচু মাটির ঢিপি বানিয়ে মঞ্চ করা হয়েছে । বিশাল শামিয়ানা টাঙিয়ে ছাউনি দেওয়া হয়েছে । অনেকটা জায়গা জুড়ে ত্রিপল বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা । মেয়েদের জন্য একধারে ব্যবস্থা হয়েছে । একটা জিনিস দেখে অবাক হলাম । কবিগান প্রধানত হিন্দু দেব-দেবীদের গুণকীর্তন বলা চলে । সেই কবিগানের আসরে মুসলমান শ্রোতার সংখ্যা নেহাত কম নয় । থুতনির নীচে ঝুলন্ত দাঁড়ি নিয়ে তারা মনযোগ সহকারে বিভোর হয়ে শুনছেন । বোঝা গেল গ্রামাঞ্চলে চিত্তবিনোদনমূলক ক্রিয়াকলাপ খুব একটা হয় না । ফলে কাফেরদের মজলিসও তারা পরম আগ্রহে উপভোগ করছেন ।

বসে থাকা শ্রোতাদের অধিকাংশই বয়স্ক । আমরা চ্যাংড়ারা এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে । মাঝে মাঝে একচক্কর ঘুরে আসছি । ক্রমে দুপুর হয়ে গেল । মধ্যাহ্নভোজ উপলক্ষ্যে ঘন্টা দুয়েক বিরতি । গানের শেষাংশ বিরতির পর । ইতিমধ্যে কর্ণ এসে আমাদের ধরে পড়লো দুপুরে ওদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য । কিন্তু দেবাশীষদের বাড়ি যাবার কথা হয়ে থাকায় রাত্রে ওদের বাড়ি যাব প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিস্তার পাওয়া গেল ।
দুপুরে ভাত, ডাল, মানকচু দিয়ে মাছের ঝাল আর মাংস সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সেরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম । কবিগানের শেষ অংশটুকু শোনার জন্য কিছু প্রস্তাব পেলেও রাত্রে যাত্রাপালা হবে শুনে একটু বিশ্রাম করে নেওয়াই স্থির হল । সন্ধ্যে নাগাদ আবার যথারীতি মেলার মাঠে । কথায় বলে নেই কাজ তো খই ভাজ । আমরা প্রকারান্তরে তাই করছি । খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুরে বেড়াচ্ছি । টুকটাক মুখ চলছে পায়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে । পা আর মুখ দুটোরই কোন বিরাম নেই । ক্রমে ক্রমে রাত হয়ে এলো । যাত্রাপালার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে । ইতিমধ্যে কর্ণর বাড়ি থেকে ডাক পড়েছে । আমি আর মেজ গিয়ে খেয়ে নিলাম । খাওয়া মিটলে রাত এগারোটার কিছু আগে সবাই দল বেঁধে চলল যাত্রা দেখতে । মেজ অবশ্য নিজের অবস্থানে অটল । ও অতিসত্ত্বর বিছানা নিল । আমি দোনামোনা করে শেষে মেলার মাঠেই চললাম । আমাদের দল অনেক পূর্বেই উপস্থিত । মালাইচাকী জোড়া লেগে যাওয়ায় প্রলয় আবার স্বমহিমায় । যাত্রা দেখতে আসা অবিবাহিতা সুন্দরীদের চিহ্নিত করে আমায় দেখাতে লাগলো । আধো আলো আধো অন্ধকারে কিছুই ঠিকমতো ঠাহর করতে না পারলেও আমি প্রলয়ের পছন্দের প্রশংসা করতে লাগলাম ।

শুরু হল যাত্রা ‘ভাগের মা ভাত পায় না’ । মুখে কিলোখানেক ফেসপাউডার, ঠোঁটে লাল রং আর চোখের তলায় হালকা কাজলের রূপরেখায় অভিনেতারা মন্দ আলোতেও বেশ উজ্জ্বল । যাত্রা খানিক্ষণের মধ্যে জমে উঠলো । নায়ক দেবব্রতর বুক চিতিয়ে মারকাটারি অভিনয়ে দর্শকবৃন্দ মোহিত । রাত যত গভীর হতে লাগলো, অভিনয়ের দাপট তত বাড়তে লাগলো । মেলার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই । শেষমেষ রাত একটার কিছু আগে আমাদের দলের কিছু সদস্যসহ আমি বাড়িমুখো হলাম । ভরা পেটে যাত্রার চেয়ে নিদ্রাটাই বেশি আপন মনে হচ্ছিলো । সারা বাড়ি ফাঁকা । শুধু মেজ বারান্দার বিছানায় মশারির ভিতর কুম্ভকর্ণের দ্বায়িত্ব পালন করছে । আমি শব্দ না করে (শব্দ করলেও অবশ্য কোন সমস্যা হত না) ধীরে ধীরে মেজর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম । কপোতাক্ষর শীতল হাওয়ায় কখন যে দুচোখ লেগে গিয়েছিল টেরও পাইনি ।
(চলবে . . . )

[আগামী পর্ব অর্থাৎ পর্ব:৬ আগামী বুধবার]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৪]

সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি পাশে মেজ নেই । ও আগেই উঠে গেছে । এখানে রাতে ঘুমটা বেশ ভালোই হচ্ছে । সারাদিনের টোটো করে বেড়ানোর ধকল আর কপোতাক্ষর হু হু হাওয়া । সব মিলে ঘুমটা হয় চমৎকার । এই চৈত্রের গরমেও মাঝরাতে চাদর গায়ে দিতে হয় । শুধুমাত্র একটাই সমস্যা । পাশে শয়নরত ঘুমন্ত মেজর মাঝেমধ্যে আমাকে পাসবালিশ বানানোর চেষ্টায় আমার ঘুমটা ভেঙে যেত । অনেকরাতেই আচমকা ঘুম ভেঙে মেজর হাত অথবা পা আমার গায়ের উপরে আবিষ্কার করেছি । কিন্তু মেজকে ঠেলে সরিয়ে নিজের ভাঙা ঘুম আবার জোড়া লাগাতে বেশি মেহনত করতে হত না । একই বারান্দায় অপরদিকে বিছানায় কাকাবাবু শুতেন । সঙ্গে দেবাশীষ । ছোট মানে সৈকত যে কোথায় ঘুমাতো, ওইখানে থাকাকালীন আমি কোনদিন ঠিকমত জানতে পারিনি । আমাদের সকলের মধ্যে ওর উৎসাহ ছিল সবথেকে বেশি । সঙ্গে বরুণ আর ওর বন্ধুরা । পাড়া বেড়ানো হোক, অন্যগ্রামে অর্কেস্ট্রা দেখতে যাওয়া হোক কিংবা মাঝরাত পর্যন্ত যাত্রা শুনতে যাওয়া হোক, এরা সর্বদা তৈরি । মেজর ব্যাপারটা একটু আলাদা । মেজর সঙ্গে বিছানার প্রেম ছিল অত্যন্ত গভীর । আর খাওয়ার পরে সে প্রেম উপচে পড়তো । তখন মেজকে ঠেকিয়ে রাখা দায় । অতএব বিছানার প্রগাঢ় ভালবাসা উপেক্ষা করে মেজর পক্ষে মাঝরাতে যাত্রা শুনতে যাওয়া সম্ভব ছিল না । আর আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা যাত্রা, থিয়েটারে আগ্রহ না থাকায় আমি মেজকে সঙ্গ দেওয়াই বাঞ্ছনীয় মনে করতাম ।

হাতমুখ ধুয়ে খাওয়া সেরে নিলাম । দিদিরা বাঁকার বাজারে যাবে কয়েকটা জিনিস কিনতে । মেজ সঙ্গে যাবে । মেজ জ্যাঠামশাইয়ের ছোট ছেলে মিঠুনও চলেছে সঙ্গে । গতকাল রাতে কিছু একটা বের করতে গিয়ে আমার ব্যাগের চেনটা ছিঁড়ে গেছে । বাজারে কোন মুচিকে দিয়ে ঠিক করে নেব চিন্তা করে ব্যাগ হাতে আমিও চললাম । একটা ভ্যানে করে আমরা বাজারে এসে নামলাম । বাজারে আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেলাম । আমি আর মিঠুন চললাম ব্যাগের ডাক্তারের কাছে । মেজ দিদিদের সঙ্গে নিয়ে অন্যদিকে অন্তর্হিত হল । আমরা এক মুচির কাছে ব্যাগ জমা দিয়ে টাকাপয়সা ঠিক করে নিয়ে বাজারটা একচক্কর ঘুরে পূর্বস্থানে ফিরে এসে বসলাম । ব্যাগ সারাই হয়ে গেলে টাকা মিটিয়ে আমরা অন্যদলকে খুঁজতে বেরোলাম । সমগ্র বাজারের গোলকধাঁধার মত গলিতে ঘন্টাখানেক চক্কর কেটেও কোন ফল হল না । ওরা কি কিনতে কোন দোকানে গেছে সে বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই । আমরা ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যখন আর খুঁজব না ঠিক করেছি, ঠিক তখনই দেখি আমাদের অন্য দলের সদস্যেরা ভরদুপুরে তেলেভাজার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁচের মধ্যে রাখা তেল চুপচুপে ভোজ্য বস্তুগুলিকে একদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছে এবং নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে । বুঝতে বাকি রইলো না যে ওই চুপচুপে বস্তুগুলিকে পেটে চালান করার মতলব কষা হচ্ছে । আমরা গিয়ে ওদের সঙ্গে মিলিত হলাম । কল্পনা দিদি আমাকে তার সুপ্ত অভিপ্রায়ের কথা বলতেই আমি পত্রপাঠ নাকচ করে দিলাম । চুপচুপে বস্তুদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি । বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে দ্বিধামন্দ কাটিয়ে একঠোঙা পেঁয়াজি হাতে বাড়ির পথে রওনা দিলাম । ফেরার পথে ভ্যানে বসেই বস্তুগুলির সদগতি করা হল ।

বাড়ি পৌঁছে শুনি পুজোর ওখানে যেতে হবে । সেখানে ঢাক-ঢোল-কাড়া-নাকাড়া সহযোগে একধরনের কাদামাখামাখির খেলা হবে, নাম তার ‘ধুলোট’ । ঈর্ষান্বিত শহুরে বাঙালি নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করেন বটে তবে গ্রামের পুজোতে যখন হবে, তখন এ নিশ্চই সে জিনিস নয় । সদলবলে গিয়ে হাজির হলাম । একটা বড় বট গাছের তলায় কিছু একটা কর্মকাণ্ড চলছে । তার চারিধারে অসংখ্য মানুষ (মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে) ডঙ্কা, ঢাক, ঢোল, করতাল নিয়ে হাজির । আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম । একটু পরেই রং মাখা হবে । সঙ্গে অবশ্যই মাটি থুড়ি কাদা । ডঙ্কা পেটানো শুরু হল । আওয়াজে কান পাতা দায় । পুজোর বাতাসা ছোড়া শুরু হয়েছে । এ যেন রণক্ষেত্র, শত্রুপক্ষের গুলির মত ধেয়ে আসছে এক একটা মূর্তিমান বাতাসা । কোনটা লাল, কোনটা সাদা । বাতাসা কুড়োতে কুড়োতে লোকে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে । আমিও নিপুণ ফিল্ডারদের মত ক্যাচ লুফে নিতে লাগলাম । একটু পরে বাতাসাবৃষ্টি থামলো, সঙ্গে গুতাগুতিও । এবারে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত । ইতিমধ্যে সুযোগ বুঝে আমাদের এক সঙ্গী কেটে পড়েছে (তাকে পরে বাড়ি থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে এনে রং মাখানো হয়েছিল) । কাদা মাখামাখি শুরু হতেই হঠাৎ প্রলয় ক্ষেপে উঠে একেবারে প্রলয়নৃত্য করতে লাগলো । ওর এত আনন্দের উৎস কি আমার বোধগম্য হল না (আসরের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকা দু-তিনজন সুন্দরী হতেও পারে)। এরকম হুড়োহুড়ি, জাপটাজাপটি যখন চলছে তখনই ঘটলো দুর্ঘটনা । কাদা মাখার জন্য বিস্তীর্ণ মাটিতে জল ঢেলে কাদা করা হয়েছিল আগেই । সেই পিছল জমিতে প্রলয় আছাড় খেল । প্রলয় পড়ে যেতেই তার পায়ের উপর গিয়ে পড়লো আরেকজন । মুহুর্তে প্রলয়ের মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো । এমন আকস্মিক দুর্ঘটনায় সকলেই স্তম্ভিত । ওই পটভূমিকায় ওই গ্রামের ডাক্তারও উপস্থিত ছিলেন । তিনি ছুটে এলেন । একটু দেখেই বললেন মালাইচাকী সরে গেছে । প্রলয়কে কোনরকমে পাঁজাকোলা করে তুলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হল । এমন আনন্দ উৎসবের মধ্যে এরকম দুর্ঘটনা ঘটায় মনটা বিষন্ন হয়ে গেল । আমি আর থাকতে চাইলাম না । আমরা স্নান করে নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম । কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কোন পুকুরে স্নান করবো তা নিয়ে । সব পুকুরেই লোকের আধিক্য । আমি প্রস্তাব দিলাম রোজ যেখানে যাই সেখানেই যাবার । সেখানে প্রচুর লোক হবে এই যুক্তিতে প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল । শেষমেষ এক পরিবারের নিজস্ব ব্যবহারের পুকুরে হাজির হলাম । পথে প্রলয়দের বাড়ি পড়ায় ওকে দেখে গেলাম । শুনলাম ডাক্তারবাবু নাকি বাংলা সিনেমার ঢঙে একটানে মালাইচাকী জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে । এখন মোটামুটি ঠিক আছে । আমরা ডাক্তারবাবুর তারিফ করতে করতে শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে পুকুরে গিয়ে নামলাম ।

পুকুরে জল প্রায় নেই বললেই চলে । কোমর সমান জল, নিচে পাঁক । পুকুরে নামার পর থেকেই আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো । তবু সাবান ঘষে রং-মাটি তুলে ডুব দিতে যাব, এমন সময় সেই বাড়ির গৃহবধূ এঁটো থালাবাসন নিয়ে তরতর করে ঘাট বেয়ে নেমে এসে পুকুরের জলে ধুতে লাগলেন । আমাদের চক্ষুস্থির । এতক্ষণে অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারলাম । রোজ দুবেলা বাসন ধোয়ার ফলে সমস্ত পুকুরের জলে তেল ভাসছে । সেই জন্য আমি নেমেই কেমন যেন মাছের ঝোলের গন্ধ পেয়েছিলাম । তেল ভাসতে দেখেওছিলাম । তখন থেকেই আমার মন খুঁতখুঁত করছিলো । এখন চাক্ষুষ করে আর একমুহুর্ত থাকতে পারলাম না । তড়িঘড়ি ভিজে গায়ে জল থেকে উঠে বাড়ির দিকে হাঁটলাম । বাড়ির সামনেই হাটখোলা বাজারের পাশে একটা পুকুর আছে । তুলনামূলকভাবে ভালো । সেখানেই বাকি স্নানটুকু সেরে বাড়ি গিয়ে খেতে বসলাম ।

ওবেলা বড়দিদিরা এসেছে । বড়দাদাবাবু (বড় জামাইবাবু) ঠাকুরদাস আমাদের নিয়ে পুজোর মাঠের দিকে চললেন । পুজো উপলক্ষ্যে মেলা লেগেছে । বড় মাঠে মন্দিরকে ঘিরে হরেকরকম পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসেছে । মেলা থাকবে বেশ কয়েকদিন ।

মেলায় মিষ্টির দোকান

বাচ্চাদের খেলনা, মেয়েদের সাজার জিনিস, খাবার দাবার, মিষ্টির দোকান, এমনকি একটা আইসক্রিমের দোকানও চোখে পড়লো । একধারে চায়ের দোকান চোখে পড়লো । চা, বিস্কুট, কেক, চানাচুর আর লোকাল সফট ড্রিংক পাওয়া যাচ্ছে । আমাদের প্রলয়ের দাদু একটা চায়ের দোকান দিয়েছে দেখলাম । ওর দাদুর অবশ্য হাটখোলার বাজারে নিজস্ব চায়ের দোকান আছে । আমরা মেলায় ঘুরে এক জায়গায় গিয়ে বসলাম । দেবুদা হঠাৎ উদয় হয়ে আমাদের আইসক্রীম অফার করলো । প্রথমে না না করেও একটা করে নিলাম ।

ওয়েফার কোণের উপর একদলা মিষ্টি বরফের গুঁড়ো

একটা কোণের উপর একদলা বরফের গুঁড়ো । মুখে দিয়ে দেখি চিনি আর জলের মিশ্রণ বরফ বানিয়ে তা গুঁড়ো করে কোণের উপর বসিয়ে বিক্রি হচ্ছে । তারপর আরও কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পর বাড়ি থেকে খাওয়ার ডাক এলো । আমি অনেক্ষণ থেকেই উসখুস করছিলাম । মেলায় ঘুরে ঘুরে আমার কোমর ধরে গেছিলো । বাড়ি থেকে ডাক আসায় খুশিই হলাম । বড়দাদাবাবু চায়ের দোকানে গল্পে মশগুল । তাকে একটা ডাক দিয়ে আমরা বাড়ি অভিমুখে যাত্রা করলাম ।
রাতের খাওয়া মিটলে অবদার রাস্তার পাশে বসার জায়গায় মিলিত হলাম । ঝড়ের মত হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে । পতাকার ন্যায় লুঙ্গি উড়ছে পতপত করে । শরীর ঠান্ডা হয়ে ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে । কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এটাই যে এত হাওয়ার মধ্যেও মশা ঠিকই কামড়াচ্ছে । এই প্রবল হাওয়াও ওদের কাজে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না । খানিক্ষণ বসেই আমরা উঠে আসলাম । কলকাতায় প্রত্যেক রাত্রে নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে হয় । নইলে সহজে ঘুম আসে না । এখানে মেঘ না চাইতেই জল । এমনিই ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে । অতএব শুয়ে পড়ি । হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই ।

(চলবে . . . )

[আগামীপর্ব অর্থাৎ পর্ব:৫ আগামী বুধবার]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৩]

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো । বিছানা পরিত্যাগ করে ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে এক মগ জল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । দাঁত মাজতে মাজতে এদিক ওদিক ঘুরে শেষে মুখ ধুয়ে ঘরে এলাম । আজ আমাদের একটা ঐতিহাসিক স্থান দেখতে যাবার কথা । এখানে এসেই শুনেছিলাম আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মস্থান এবং একসময়কার বসতবাড়ী খুলনা জেলার রাড়ুলি গ্রামে । এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় । একঢিলে দুই পাখি মারার লোভনীয় সুযোগ ছাড়তে চাইনি । তারই ফলশ্রুতি এই যাওয়া । যারা বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালিকে গৌরবান্বিত করেছেন, প্রফুল্লচন্দ্র তাদের অন্যতম । বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণীর । রসায়নশাস্ত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য । কলকাতায় তার সম্বন্ধে অজস্র বই দেখেছি, এমনকি কলকাতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাস্ত রাস্তার নামকরণ তার নামানুসারে করা হয়েছে । তার তৈরি ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ কলকাতার বুকে এখনো বর্তমান । এহেন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না । অতএব খাওয়া দাওয়া সেরে আমাদের ছোট্ট দলটা বেরিয়ে পড়লো । আমি, মেজ, দেবাশীষের ভাই বরুণ আর ওর তিনজন বন্ধু কুমারেশ, কর্ণ আর প্রলয় । ওখানে গিয়ে সকলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গিয়েছিল । এগারোটা নাগাদ শ্রীধরপুরের মোড়ে এসে দাঁড়ালাম ।

ভ্যান আগে থেকে ঠিক করা আছে । তাকে ফোন করে জানা গেল সে মাঝরাস্তায়, আমাদের নিতেই আসছে । পাঁচমিনিটে এসে পড়বে । কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভ্যান আসলো । পূর্বপরিচিত হওয়ায় ভ্যানচালকের কাঁধে আমাদের ঘোরানোর দ্বায়িত্বটা চাপিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম । ভ্যানচালকের নাম রবিন । মাঝবয়সী, একহারা চেহারা । আমরা ছয়জন চেপে বসতেই ভ্যান চলতে শুরু করলো । কালাবাঘির বাজার ফেলে রেখে চলেছি । দুপাশে ধানক্ষেত পিছনে সরে যাচ্ছে । কিছুক্ষণের মধ্যে বাঁকা বাজারে এসে পড়লাম । বাঁকার মূল বাজারটা কপোতাক্ষ নদীর ওপারে খুলনার মধ্যে পড়ে । আমরা এগিয়ে চললাম । অনেক রাস্তা গিয়ে অবশেষে বারোটার কাছাকাছি আমরা প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বাড়ি পৌঁছলাম ।

আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের বাসভবন

সামনে ছোটখাট একটা মাঠ । সবুজ ঘাসে ঢাকা । সম্পূর্ণ জমিটা কাঁটাতারে ঘেরা । একপাশে ঢোকার গেট । গেট দিয়ে ঢুকলে বাঁহাতে দারোয়ানের ঘর । ঘর উপস্থিত, দারোয়ান অনুপস্থিত । আমরা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে গেলাম ।

সদরমহল

বাঁহাতে আম-কাঁঠালের বাগান । আমি আর মেজ ছাড়া বাকি সকলেই এখানে আগেও এসেছে । ওরা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল । আমরা মূল বাড়ির বাঁপাশে এসে উপস্থিত হয়েছি । বিশাল জমিদার বাড়ি । বাড়ির নাম ‘সদরমহল’ । একপাশে লম্বা টানা বারান্দা বেশ খানিকটা চলে গেছে । বারান্দা শেষ হলেই বিশাল এক সিংহদুয়ার । দরজা এখন বন্ধ । বারান্দায় বসে এক ভদ্রমহিলা তরকারি কাটছেন । জিজ্ঞেস করতে বললেন কিছুক্ষণ পরে এখানকার দেখভালের দ্বায়িত্বে থাকা কেয়ারটেকার এসে দরজা খুলে দেবে । তখন আমরা ভিতরে গিয়ে দেখতে পারব । আমরা ততক্ষণে পিছনের অংশটা দেখে আসতে পারি ।
আমরা সদলবলে বাড়ির পিছনের দিকে চললাম । পিছনেও বিবিধ গাছের সারি । কয়েকগজ যেতেই আরেকটি মহল ।

অন্দরমহল

সামনে পাথরের ফলকে লেখা ‘অন্দরমহল’ । সঙ্গে এর ইতিহাস । এই বাড়িটি পরিবারের মেয়েদের জন্য তৈরি করা হয় । সদরমহলের থেকে কিছু ছোট এই মহলের প্রথম তলার বারান্দায় খিলান ও দ্বিতীয়তলার বারান্দায় জোড়াখুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে ।

নীচে খিলান আর উপরে জোড়া খুঁটির ব্যবহার

কথিত আছে এই মহলেই ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৮৭০ সালে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসার আগে পর্যন্ত নয় বছর তিনি গ্রামে কাটিয়েছেন । সেই সময় তিনি গ্রামেরই পাঠশালায় পড়তেন, এই বাড়ির প্রাঙ্গণে খেলা করতেন, এই বাড়িরই কোন ঘরে ঘুমাতেন ।

কড়িকাঠ

আজ আমরা সেই স্থানে দাঁড়িয়ে । এক অজানা রোমাঞ্চে গায়ে কাঁটা দিল । আমরা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । কোন এককালে সুন্দর থাকলেও বর্তমানে ভগ্নদশাপ্রাপ্ত পোড়োবাড়ির রূপ নিয়েছে । চুন-সুড়কি খসে পড়ছে । বিবিধ পোকামাকড় আর ইঁদুরের বাসা ।

নীচের টানা বারান্দা

বারান্দা সংলগ্ন ঘরে ঢুকে দেখলাম পিছনদিকের দেওয়াল ধ্বসে গেছে । ফলে পিছনদিক উন্মুক্ত । বাঁহাতে একটা ছোট্ট ঘর । সেটা ছাড়িয়ে বাঁহাতে দোতলায় যাবার সিঁড়ি । একেকটা প্রায় দু-ফুট উঁচু । এ যেন স্বর্গের সিঁড়ি ।

স্বর্গের সিঁড়ি

দশ ধাপ উঠে সামনেই ছোট্ট ঘর । ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি মেঝে ভেঙে পড়ে গেছে । একপাশে খানিকটা অংশ বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে । তারই উপর দিয়ে কোনরকমে পাশের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলাম । এটা হয়তো শোবার ঘর ছিল এককালে । লাগোয়া টানা বারান্দায় গিয়ে ঘুরে আবার ফিরে এলাম । এখানে বেশিক্ষণ কাটানো অত্যন্ত বিপজ্জনক । বেরিয়ে আসার আগে ছাদটা দেখে এলাম । তার অবস্থাও বড়ই করুণ । যত্নের অভাবে এই দুরবস্থা ।

সদরের অন্দরে

অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আমরা সদরমহলের দিকে এগোলাম । সেই সিংহদরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বারান্দা থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক নেমে এলেন । হাতে একগোছা চাবি । ইনিই এখানকার কেয়ারটেকার । নাম তপন দত্ত । নির্দিষ্ট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দিলেন ।

সদরমহল

ভিতরের গঠন অনেকটা কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ন্যায় । মাঝখানে বিশাল উঠোন । দুপাশে খিলান দেওয়া টানা বারান্দা ও ঘরের সারি ।

খিলান দেওয়া টানা বারান্দা

সামনে দুই থামের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দায় ওঠার জন্য । বারান্দায় উঠলেই সামনে দুর্গামন্ডপ ।

দূর্গামন্ডপ
প্রাচীন নকশা
দূর্গামন্ডপের ভিতর থেকে . . .

এককালে এখানে দুর্গাপুজো হত । উঠোনের চারিধারে কেয়ারি করা ফুলের বাগান । অন্দরমহলের থেকে সদরমহলের অবস্থা খানিকটা ভালো । এই সদরমহলেরই দুটো ঘর নিয়ে তপনবাবু সপরিবারে থাকেন । তখন যিনি বারান্দায় বসে আনাজ কাটছিলেন তিনিই তপনবাবুর স্ত্রী ।  আমাদের দেখা হয়ে গেলে তপনবাবু একটা বাঁধানো খাতা আর কলম এনে ধরিয়ে দিলেন আমাদের মন্তব্য লেখার জন্য ।

ঠাকুরবাড়ির ধাঁচে

আমি আর বরুণ দুজনে দুটো মন্তব্য লিখে ফেরৎ দিতে তপনবাবু আক্ষেপ করে বললেন বাংলাদেশ সরকারের অবহেলায় এমন একটা জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । সঙ্গে এও জানালেন যে তিনি নাকি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবিত বংশধরদের একজন । তার পৈতৃক বাড়ি যশোরের সাগরদাঁড়ি । তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সেখানেই থাকেন । তারপর গলা খাটো করে বললেন সরকার থেকে এই অট্টালিকার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পঁচিশ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে । এখনো কেউ জানে না । জানলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে কোনভাবে বাগানোর জন্য । আমি আর বরুণ একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে তপনবাবুকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে ভ্যানে গিয়ে বসলাম ।
এবার আমরা যাব আরেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মাইকেল মধুসূদন দত্তের মামার বাড়ি । ভ্যানে আসতে আসতে রবিনের কাছে শুনেছিলাম । আবার তপনবাবুও বললেন । অতএব সেদিকেই রওনা দিলাম । পথে প্রফুল্লচন্দ্রর পিতা স্বর্গীয় হরিশচন্দ্র রায়ের নামাঙ্কিত কলেজ দেখলাম ।

কাটিপারাতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মাতুলালয় । আগেকারদিনে মেয়েদের প্রসবকালে পিতৃগৃহে নিয়ে আসা হত । ফলে অধিকাংশ শিশু তার মাতুলালয়েই জন্মগ্রহণ করতো । মধুসূদনও এর ব্যতিক্রম নন । তিনি জন্মেছিলেন কাটিপারায় মামার বাড়িতে । রাড়ুলি থেকে কাটিপারা আসতে বেশি সময় লাগলো না । বাজার থেকে খানিকটা ভিতরে ঢুকতেই একটা স্কুলের পাশে কিছু ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়লো ।

জোড়া শিবমন্দির

একটা বড় বটগাছ, পাশাপাশি দুটো শিবমন্দির এবং তার পাশে মূল বাড়ির অংশ । বর্তমানে বাড়ির অধিকাংশই অদৃশ্য ।

মধুসূদনের মাতুলালয়
দুর্দশাগ্রস্ত শিবমন্দির

এইখানেই মেঘনাদবধ কাব্যের রচয়িতার জন্ম । এখন আর কিছুই আস্ত নেই । অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল । ফিরে আসবো ঠিক করেছি, এমন সময় আমাদের ভ্যানচালক রবিন জানাল এখানেই কাছাকাছি বহু পুরনো কিছু পোড়ো মন্দির আছে । ও অনেকদিন আগে একবার এসেছিল । আমরা পুরনো বাড়িঘর দেখছি দেখে জানাল, যদি যাই । ভাবলাম এসেছি যখন, ঘুরেই আসি । বারবার তো আসা হবে না । অতএব চললাম অপরিকল্পিত নতুন গন্তব্যের দিকে ।
এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা ধরে খানিক গিয়ে একটা সরু পায়ে হাটা পথ দিয়ে এগিয়ে গেলাম । বিশাল বিশাল বটগাছ আর অন্যান্য গাছের উপস্থিতিতে জায়গাটা জঙ্গলের মত হয়ে আছে । দূর থেকে ইঁট বেরিয়ে পড়া কিছু মন্দিরের কঙ্কাল চোখে পড়লো ।

ঘোষেদের মন্দির
পোড়া ইটের স্থাপন
মন্দিরের পিছনের রাস্তা
মন্দিরের ভিতর থেকে . . .

দেখে মনে হচ্ছে যেন লাল লাল দাঁত বের করে হাসছে । সাপখোপ আছে কিনা চিন্তা করতে করতে মন্দিরে গিয়ে ঢুকলাম । মন্দিরের বয়স ১৯০ বছর । এত পুরনো হওয়া সত্ত্বেও এখনো তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত । মন্দিরের গায়ে তখনকার কিছু কিছু স্থাপত্যশৈলীর পরিচয় পাচ্ছিলাম ।

১৯০ বছর পুরনো নকশা
প্রাচীন নকশা

মন্দির থেকে বাইরে এসে দেখি পায়ে চলা রাস্তা ধরে বয়স্ক এক দাড়িওয়ালা চাচা চলেছে মসজিদে দ্বিপ্রহরের নমাজ আদায় করতে । তাকে জিজ্ঞেস করতে সংক্ষেপে জানাল এইসব জমি এককালে ঘোষেদের ছিল । দেশভাগের আগেই তাঁরা ‘ইন্ডিয়ায়’ চলে যায় । তারপর সব এখন মুসলমানের দখলে । তাদেরই বসতবাড়ীটি বর্তমানে মসজিদ হয়েছে আর শিব মন্দির, রাধাকৃষ্ণের মন্দির ইত্যাদি সমস্তই ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে ।

রাধাকৃষ্ণের মন্দির
তোরণের ধ্বংসাবশেষ

নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো । একেই বলে নিয়তি । কার অর্জিত সম্পত্তি আর ভোগ করে কে ! আমরা ভ্যানে ফিরে এলাম ।
রবিন বাড়ির পথ ধরলো । ফেরার সময় বড়ো রাস্তা দিয়ে না গিয়ে গ্রামের ভিতরের কাঁচা রাস্তা ধরে চলতে লাগলো । সকাল থেকে ঘোরাঘুরিতে সকলেই কম বেশি ক্লান্ত । মাঠ-ঘাট-ধানক্ষেত দেখতে দেখতে চলেছি । রবিন ওর ছেলেবেলার গল্প বলতে লাগলো । আমরা কম-বেশি তাল দিতে লাগলাম । প্রায় বেলা দুটো নাগাদ হোসেনপুর পৌঁছলাম । অনেক চেষ্টা করেও ভাড়া দিতে বিফল হলাম । ওরা সকলে মিলে ভাড়া মিটিয়ে দিল । একটু পরে লুঙ্গি ও গামছা সমেত পুকুরপাড়ে দেখা হবে জানিয়ে সকলে বিদায় নিল । আমরাও বাড়ি গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে পুকুরে চললাম ।

দুপুরের খাওয়া শেষ হতে বেলা হয়ে গেল । ইতিমধ্যে একে একে আত্মীয়-পরিজনদের আসা শুরু হয়েছে । আমরা দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি কাকাবাবু গিয়ে কল্পনা দিদিকে নিয়ে এসেছেন । সঙ্গে দুই ছেলেমেয়ে । বড়দিদি ঝর্ণা আর ছোটদিদি অপর্ণা আগামীকাল পুজোর দিনেই আসবে । কল্পনা দিদির মেয়ে ঐশী আর সাথী সমবয়সী হওয়ায় ওরা খেলায় মেতে উঠেছে ।

বাঁদিকে ঐশী এবং ডানদিকে সাথী

বাড়িতে বেশ একটা হইচইয়ের মেজাজ । আমরা নীচে লুঙ্গি ওপরে স্যান্ডো চড়িয়ে, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে লাগলাম । নতুন হওয়া বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা লেগেই আছে । ওখানে যাবার পর থেকেই মোবাইলের সঙ্গে যোগাযোগ শুধুমাত্র ছবি তোলা উপলক্ষ্যে । ভারতীয় সিমকার্ড ওখানে অচল । ইতিমধ্যে প্রলয় এসে জানাল যে ওর কাছে দুটো সিমকার্ড আছে । প্রয়োজন হলে আমি কয়েকদিন ব্যবহার করতে পারি । মেজ আর ছোট প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হস্তগত করলো । অতঃপর কর্ণ নিজের একটা রবি সিমকার্ড এনে আমাকে দিল । সিমকার্ড নিয়ে রিচার্জ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভারতে যোগাযোগ । সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল । রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে, ফলে আড্ডা ভাঙতে হল । খেয়ে শুতে হবে । আগামীকাল পুজো ।

(চলবে . . . )

[আগামীপর্ব অর্থাৎ পর্ব:৪ আগামী বুধবার]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব:২]

‌ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেলা প্রায় আটটা । এমনিতে গ্রামের দিকে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার রেওয়াজ আমি ভারতেও দেখেছি । তবে এখানে যেন অতি ভোরে ওঠার চল । বাড়ির মহিলারা (বিশেষ করে গৃহবধূ) অতিভোরে (প্রায় মাঝরাতেই বলা চলে) উঠে গৃহকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে । উঠোন ঝাঁট দিয়ে, গোবর লেপে, উনোনে ছাই তুলে ভাত চাপিয়ে দেওয়া । ওদেশে মুগ ডালের প্রচলন বড্ড বেশি । প্রায়ই দেখতাম ডালের মধ্যে কখনও লাউ কখনও সজনে ডাঁটা দিতে । খেতে অবশ্য মন্দ লাগতো না । সঙ্গে কখনও মানকচু দিয়ে, কখনও মেটে আলু দিয়ে, কখনও কাঁচ কলা, কখনও বা শুধু আলু দিয়েই মাছের ঝোল । জ্যাঠামশাইয়ের ছোট্ট একটা পুকুর আছে । তাতে জাল ফেললেই দুবেলার মাছ উঠে আসত । টাটকা জ্যান্ত মাছের স্বাদই আলাদা । ঘুম থেকে উঠে দেখি খাদ্য প্রস্তুত হয়ে খাদকের অপেক্ষায় বসে আছে । এখানে তিনবেলা ভাত বরাদ্দ । হাত মুখ ধুয়ে ভাতের থালা নিয়ে বসলাম । খাওয়া হলে দেবুদা জিজ্ঞেস করলো পানীয় জল আনতে ওর সঙ্গে যাব কিনা । আমরা এককথায় রাজী । আমি, মেজ আর দেবুদা দুটো সাইকেল আর ড্রাম নিয়ে রওনা হলাম । যেতে যেতে শুনলাম আমাদের গন্তব্য বাবুর পুকুর । সেই পুকুরের জলই নাকি আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ এসে নিয়ে যায় পান করার জন্য । এই পুকুরের জল খাওয়ার জন্য নেওয়া ছাড়া অন্য কোনভাবে ব্যবহার নিষিদ্ধ । প্রথমে আমার মনের মধ্যে একটা খারাপ লাগা তৈরি হচ্ছিলো, কিন্তু যখন শুনলাম আমরা এবাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকে ওই পুকুরের জলই খাচ্ছি, তখন হাল ছেড়ে দিলাম । যা থাকে কপালে বলে চললাম জল আনতে । দেবুদা আর মেজ একটা সাইকেলে আর আমি অন্যটায় । প্রথমে অবদার রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে উঁচু রাস্তা ছেড়ে এবড়ো খেবড়ো কাঁচা রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে দিলাম । রাস্তা এঁকেবেঁকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে চলেছে । গ্রামের নাম বাঁকা । বেশ খানিকটা গিয়ে দূর থেকে একটা চুন-সুড়কি খসে যাওয়া পাঁচিল, প্রবেশদ্বার এবং তৎসংলগ্ন অনেকগুলো থামওয়ালা চন্ডীমন্ডপ গোছের চোখে পড়লো ।

ছবি – প্রায় দেড়শ বছর পুরনো স্তম্ভ ও পাঁচিল

কাছে যেতেই পুকুরটা দেখতে পেলাম । পাঁচিলের বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই । পুকুর শালুক ফুল আর তার পাতায় ভরে গেছে ।

ছবি – বাবুর পুকুর

দেখেই আমার চক্ষু চড়কগাছ । সর্বনাশ !! এই জল খাচ্ছি আমরা ! পেটের মধ্যে কেমন যেন গুড়গুড় করে উঠলো । দেবুদা অভয় দিয়ে আবার একবার মনে করিয়ে দিল যে আশপাশের একাধিক গ্রামের লোক এই পুকুরের জল খেয়ে চলেছে । কারোর কোন পেটের রোগ হয়েছে বলে শোনা যায়নি । আমি আর মেজ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে গেলাম । দেবুদা ড্রাম হাতে বিশাল চওড়া বাঁধানো ঘাট ধরে নেমে গেল জলের দিকে । আমরা পাড়ে দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখতে লাগলাম । পুকুরের পরিধি নেহাত কম নয় । লম্বায়-চওড়ায় বেশ বড় । চারিধারে ঘাসের জমি দিয়ে ঘেরা । তার ওপারে আম গাছের সারি । জল যেমনই হোক, পরিবেশটা মন্দ নয় । পুকুরটা অবিনাশ বাবু নামে কোন এক জমিদারের ছিল এককালে । কথিত আছে জমিদার অবিনাশ বাবু স্বপ্নে পেয়ে একরাতে পুকুরটি কাটিয়েছিলেন । ক্রমে জমিদারি অবলুপ্ত হয় । দেশভাগের পর এই অবিনাশ বাবুর বংশধর পিন্টুবাবু ভারতবর্ষে চলে আসেন ।

দেবুদার জলভরা হলে আমরা বাড়ির পথে রওনা হলাম ।বাড়ি এসে শুনি আমাদের কুলপোঁতায় বড়দির বাড়িতে যেতে হবে । অতঃপর স্নান করে তৈরি হয়ে নিলাম । তাড়াহুড়ো করেও যখন শেষপর্যন্ত রওনা হলাম তখন ঘড়িতে এবং আমাদের দুজায়গাতেই বারোটা বেজে গেছে । ভর দুপুরে রোদের মধ্যে আমরা শ্রীধরপুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে । আমরা মানে আমি, মেজ, সৈকত আর কাকাবাবুর জ্যাঠতুতো দাদার ছেলে দেবাশীষ ।

ছবি – আমি, মেজ আর দেবাশীষ

আমরা পৌঁছনো থেকে দেবাশীষ আমাদের অস্থায়ী গাইড । বড় শান্ত আর লাজুক ছেলে । আজকালকার চ্যাংড়া প্রজন্মের সঙ্গে বেমানান । বাসের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও বাসের দেখা না পেয়ে একটা ভ্যান দেখে দরদাম করে তাতে চড়ে বসলাম । এদেশে প্রায় সবকিছুতেই দরদাম চলে । ভ্যান চলেছে । আমরা পা ঝুলিয়ে হাওয়া খেতে খেতে চলেছি ।

দুধারে প্রায় হাজার বিঘের মাছের ঘের । প্রধানত বাগদা চিংড়ির চাষ । রোদের তেজ থাকলেও প্রচন্ড হাওয়ায় তা মালুম হচ্ছে না । দিব্যি যাচ্ছিলাম । কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই বিপত্তি । আমাদের ভ্যানের ডানপাশের টায়ার লিক হয়ে গেছে । অতঃপর ভগবানের দেওয়া পা-ই ভরসা । প্রখর রৌদ্রে হেঁটে হেঁটে কাঁহাতক পারা যায় ! জান একেবারে কয়লা । হাঁটতে হাঁটতে দরদর করে ঘামছি আর ভ্যানওয়ালার মুণ্ডপাত করছি এমন সময় দেখি এক ভ্যানো ভটভটিয়ে হলদিপোঁতার দিকে চলেছে । আহা, ভগবান যেন স্বয়ং দূত পাঠিয়েছেন আমাদের উদ্ধার করার জন্য । আমরা মরিবাঁচি করে ঝাঁপিয়ে পড়ে চলন্ত ভ্যানোকে থামালাম । কদ্দুর যাবে জেনে নিয়ে হিসেব কষে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে রাজী করিয়ে ফেললাম । রোগা, কালো মাঝবয়সী এক যুবক । একই রাস্তায় যাবে । ফাঁকা যাবার চাইতে কয়েকজন তুলে নিলে বরং তেলের খরচটা উঠে আসে । আমরা চেপে বসলাম । ভ্যানো আবার ভটভটিয়ে ছুটলো । মাঝপথে থেমে কিছু সময় নষ্ট করার জন্য ইঞ্জিন ভটভট করে যেন ধমক দিতে দিতে চলল । বাহাদুরপুর ছেড়ে বেশ খানিকটা গিয়ে একটা দুই রাস্তার মোড়ে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লাম । সেখান থেকে আরেক ভ্যানে মহিষাডাঙা বাজার । বাজারে পৌঁছে ভ্যান ছেড়ে দিয়ে এক মিষ্টির দোকানে সেঁধিয়ে গেলাম ।

প্রচন্ড গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ । দেবাশীষ একভাঁড় দই নিয়ে দরাদরি করছে আর মেজ তাকে সাহায্য করছে । আমি আর সৈকত কোনভাবে খানিকটা শীতল পানীয় গলায় ঢালা যায় কিনা সেই চিন্তা করছি । এদিক ওদিক জরিপ করতে গিয়ে চোখে পড়লো লোকাল কিছু ঠান্ডা পানীয়ের বোতল । পঁচিশ টাকা করে দুজনে দুরকম বোতল কিনে গলায় ঢাললাম । কল্পনায় যে সুখানুভূতি দেখা দিয়েছিল, মুহুর্তে তা অন্তর্হিত হল । আমি যেটা নিয়েছিলাম তার নাম SPEED আর সৈকত যেটা নিয়েছিল তার নাম TIGER । ঠান্ডা পানীয় গলায় ঢালতেই মনে হল যেন কাফ সিরাপ ঢেলে দিয়েছি । চারজনে দুবোতল কোনক্রমে শেষ করে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম । ঘড়িতে দেড়টার কিছু বেশি । দিবাকর মধ্যগগনে । কাঠফাটা রোদে আমরা চার মূর্তিমান হাতে দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে নিজের ঘামে নিজেই স্নান করতে করতে হেঁটে চলেছি । পা টলমল করছে । এই বসন্তের দাবদাহেও ক্ষেত ভর্তি সর্ষের ফুল দেখছি (ফেরার সময় অবশ্য দেখলাম সেগুলো সব ধানের ক্ষেত) । শেষমেষ কোনরকমে যখন দিদির বাড়ি পৌঁছলাম তখন দুটো বাজে ।

এখানেও মাটির বাড়ি । গোলপাতার ছাউনি । দাওয়ার একপাশে লাগোয়া বেশ বড়সড় মাটির রান্নাঘর । দাওয়ায় উঠে দেখি দিদি রান্না করছে । আমরা আসছি শুনে দিশি মোরগ সকালেই আত্মবলিদান দিয়েছে । কড়াইতে ফুটন্ত তারই দেহাবশেষ । আমরা মুখহাত ধুয়ে জামা খুলে শীতলপাটিতে ছড়িয়ে বসলাম । দাদাবাবু (জামাইবাবু) ঠাকুরদাস আমাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো । বড়দির একছেলে হিমেল ও একমেয়ে সাথী । মেয়ে বড় । বয়স এগারো-বারো হবে । কিছুক্ষণের মধ্যে খাওয়ার ডাক পড়লো । আরেকপ্রস্থ চোখেমুখে জল দিয়ে আসনে গিয়ে বসলাম । বড় থালাতে পরিপাটি করে ভাত সাজানো । তবে পরিমাণ দেখে আমাদের চক্ষুস্থির । অনেক অনুরোধের পর খানিকটা ভাত তুলে দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম । ডাল, দুরকম মাছ, অবশেষে মোরগ বাবাজি । দুর্দান্ত রান্না । ঝাল একটু বেশি হলেও চেটেপুটে মেরে দিলাম । খাওয়া শেষ হতে উঠতে যাব এমনসময় সিমুইয়ের পায়েস এসে উপস্থিত । সঙ্গে আমাদেরই নিয়ে যাওয়া দই । পেটে আর একবিন্দু জায়গা অবশিষ্ট নেই । বিকেলে ফেরার সময় ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করবো বলাতে ওঠার অনুমতি পেলাম । হাতমুখ ধুয়ে পাশেই ছোট্ট খোলা মাঠে ধানক্ষেতের পাশে মাদুর বিছিয়ে বসা হল । ইতিমধ্যে সাথী খানদুয়েক বালিশ এনেছে । এরপর চোখ আর বাঁধ মানছে না ।


খানিক আড্ডা দিয়ে, হুল্লোড় করে সময়টা কেটে গেল । সূর্যদেব পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে । আমরা উঠে পড়লাম । জামাকাপড় পড়ে রওনা দেবো এমন সময় দিদি সেই বকেয়া পায়েস আর দই এনে হাজির । কিছুক্ষণ শুয়ে বসে যে জায়গাটুকু খালি করেছিলাম তা আবার ভরে গেল । আমরা কোনক্রমে হাঁটা দিলাম । পড়ন্ত বিকেলে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে মন্দ লাগছিল না । কিছুদূর এসে দাদাবাবু খানকয়েক SPEED কিনলেন ।

ছবি – SPEED

এর স্বাদ আমাদের জানা থাকায় আমরা প্রত্যাখান করতে লাগলাম । কিন্তু আমাদের বাধা ধোপে টিকলো না । অবশেষে সকলকেই কমবেশি পান করতে হয়েছিল । ব্রিজের কাছে এসে আমরা একটা ইজি বাইক নিয়ে নিলাম । আমাদের এখানকার টোটো ওখানে ইজি বাইক । ফেরার সময় আমাদের সঙ্গে সাথী চলেছে ওর মামার বাড়ি ।

ছবি – মহিষাডাঙা ব্রিজের ওপর আমরা পাঁচজন

দাদাবাবু আর দিদি ছেলেকে নিয়ে দুদিন বাদে আসবে । আমরা গুছিয়ে বসতেই ইজি বাইক ছেড়ে দিল । অনেকক্ষণ চলার পর যখন শ্রীধরপুর পৌঁছলাম তখন সন্ধের অন্ধকার জমতে শুরু করেছে । ভাড়া একশো টাকা মিটিয়ে দিলাম । পথশ্রমে ক্লান্ত দেহে যখন বাড়ি ঢুকলাম তখন তুলসীতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠেছে ।

 

(চলবে…..)

[পরের পর্ব অর্থাৎ পর্ব : ৩ আগামী বুধবার . . . ]

‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব:১]

ঘড়িতে সকাল সাড়ে দশটা । গায়ে জ্বর নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে দাঁড়িয়ে । যদিও ভর্তি করে আনা ফর্ম আর পাসপোর্ট হাতে ভিসার লাইনে দাঁড়িয়ে আছি (বা বলা ভালো ফুটপাথে বসে আছি, কারণ প্রচন্ড জ্বরে তখন আমার দাঁড়ানোর অবস্থা নেই) তবু আদৌ যাওয়া হবে কিনা এই আশঙ্কায় মন দোদুল্যমান । নির্দিষ্ট দিনের আগে জ্বর অন্তর্হিত না হলে যাওয়ার প্রশ্নই আসছে না । অনেক সময় এবং পরিশ্রম খরচ করে যখন পাসপোর্ট জমা দিয়ে একটা চিরকুট হাতে বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখন বেলা প্রায় দেড়টা । আমার বন্ধুবর অশোক মাঝরাতে (প্রায় রাত তিনটে) লাইন দিয়ে, তা মেজ ভাই কুমারেশ আর কাকাবাবুর (অশোকের বাবা) কাছে হস্তান্তরিত করে চলে আসে । তারপর আমি গায়ে প্রবল জ্বর সমেত বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ যাই । চারজন মানুষের প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টার পরিশ্রমের ফল হাতে আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিই । নির্দিষ্ট দিনে মেজ গিয়ে সবার পাসপোর্ট (ভিসার স্টিকার সাঁটানো) নিয়ে আসে ।
অবশেষে আমরা পয়লা এপ্রিল বেরিয়ে পড়ি । গন্তব্য বাংলাদেশ । এটা আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ । যদিও বাংলাদেশ আমার কাছে কোনদিনই বিদেশের স্থান লাভ করেনি । ওখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ আমার কাছে অচেনা নয়, অজানা নয় । আমাদের পূর্বপুরুষ বাংলাদেশের বাসিন্দা ছিলেন । এখনো খুঁজলে তাদের শরিকদের দেখা মিলতে পারে । তাই ছেলেবেলা থেকেই বাংলাদেশের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি । গল্প শুনেই দেশটা খানিকটা চেনা হয়ে গেছে । পূর্ব আর পশ্চিম বাংলা যেন ভাই ভাই ।

আমাদের চারজনের দল । আমি, অশোকের মেজভাই কুমারেশ (মেজ), অশোকের ছোটভাই সৈকত (ছোট) আর  অশোকের বাবা (কাকাবাবু) । বিধাননগর স্টেশন থেকে যখন হাসনাবাদ লোকালে উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন আটটার ঘর ছুঁই ছুঁই । তারপর বসিরহাট নেমে টোটোতে বোটঘাট এবং সেখান থেকে অটোতে যখন ঘোঁজাডাঙা চেকপোস্ট পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা । টাকা বদলে, পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের ছাপ্পা লাগিয়ে যখন পায়ে হেঁটে ওপারে ভোমরা পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে বারোটার কিছু বেশি । ওপারে একইভাবে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস সামলিয়ে কাছেই সোনালী ব্যাংকে মাথাপিছু পাঁচশো টাকা ভ্রমণ কর জমা করে রওনা হলাম সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে ।

ছবি – টেম্পো

ওদেশে আমাদের অটোর মতই একধরনের হ্যান্ডেল ও গিয়ারওয়ালা তিনচাকা যান আছে, তার নাম টেম্পো ।

ছবি – বিখ্যাত বুমেরাং হ্যান্ডেল

এতে মুখোমুখি দু-সারিতে পাঁচ পাঁচ দশজন আর সামনে চালকের পাশে জনা দুয়েক বসা যায় । বিকট শব্দদূষণকারী হিসেবে এই লজ্ঝরে গাড়ির বেশ নামডাক আছে ।

 

এইরকম বাহনে করে, তার থেকেও দুর্দশাপূর্ণ রাস্তা ধরে ধূলিধূসরিত হয়ে যখন সাতক্ষীরা নিউ মার্কেটের সামনে পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন প্রায় দেড়টা বাজতে চলেছে । এটা একটা তিনরাস্তার মোড় । যে রাস্তা দিয়ে আমরা এলাম সেটাই সোজা চলে গেছে যশোরের দিকে । আরেকটা রাস্তা মুন্সিপাড়া দিয়ে বুধহাটার দিকে গেছে । আমরা এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম । দুধারে বিবিধ দোকানের সারি । কিছুদূর যেতেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ক্লাবহাউস গোছের একটা বাড়ি চোখে পড়লো । ইতিমধ্যে আমাদের গন্তব্যের একটা বাস দেখতে পেয়ে চেপে বসলাম । বাসের দশাও বড়ই করুণ । আমাদের এখানকার দূরপাল্লার বাসের মত হলেও তার আকৃতি ও রং বড়ই বিচিত্র । গতিও বড়ই ধীর ।  পথে অকারণ বিলম্ব করা যেন এর অবশ্য কর্তব্য কোন কাজ । বেশ খানিক যাওয়ার পর কুল্যার মোড়ে বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তা নিল । এই রাস্তা বাঁকা বাজার হয়ে সাতক্ষীরা ছাড়িয়ে খুলনার মধ্যে পাইকগাছার দিকে কতদূর চলে গেছে তা বলতে পারি না । অনেকটা গিয়ে শ্রীধরপুর নামলাম । একটা ভ্যানে মালপত্র তুলে দিয়ে উঠে পড়লাম । ভ্যান চলল অবদার উঁচু রাস্তা ধরে । কিছুদূর যেতেই হোসেনপুর গ্রাম । অবদার রাস্তা ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় ঢোকার মুখে প্রথম বাড়িটিই আমাদের গন্তব্য । জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি । ভাড়া মিটিয়ে মালপত্র নিয়ে যখন বাড়িতে প্রবেশ করলাম ঘড়িতে তখন চারটে বাজে ।

অশোকের বাবা তিনভাই । অশোকের বাবা মানে কাকাবাবু ছোট । ইনি ভারতেই বসবাস করেন । বাকি দুই জ্যাঠা বাংলাদেশেই থেকে গেছেন । এপার হননি । আমরা প্রধানত বড় জ্যাঠার অতিথী ।

অবদার উঁচু রাস্তা থেকে নীচে নামলেই বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি । তারপরেই উঠোন । উঠোনকে ঘিরে গোলপাতার ছাউনি দেওয়া তিনটে মাটির ঘর । একটা বড় জ্যাঠামশাইয়ের,  একটা মেজ জ্যাঠামশাইয়ের, আর অন্যটা কাকাবাবুর ছিল যখন উনি এদেশে থাকতেন । বর্তমানে এটি বড় জ্যাঠামশাইয়ের হেফাজতে । বাড়িতে ঢোকার মুখেই একজোড়া তালগাছ । পাশেই একটা লিচু গাছ দাঁড়িয়ে আছে । এছাড়াও আম এবং সজনে গাছ চোখে পড়লো ।

বড় জ্যাঠার এক ছেলে দেবব্রত, ও তিন মেয়ে, যথাক্রমে ঝর্ণা, কল্পনা আর অপর্ণা । তিনজনেই বিয়ে করে সংসারী । গ্রামের কালীপুজো উপলক্ষ্যে সকলেরই আসার কথা, কাল পরশুর মধ্যে এসে পড়বে হয়তো । আমরা উঠোনে গিয়ে দাঁড়াতেই বৌদি শীতলপাটি পেতে দিলেন । আমরা জামাকাপড় ছেড়ে গামছা পড়ে একখান লুঙ্গি কাঁধে ফেলে পুকুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । আসার আগেই শুনেছিলাম এখানে পুকুরে স্নানের চল । টিউবওয়েলের প্রচলন নেই ।

পেটে ছুঁচোয় ডন-বৈঠক তো দূরের কথা রীতিমত মুগুর ভাঁজা শুরু করে দিয়েছে । সেই কোন সকালে এক প্যাকেট নুডলস খেয়ে বেরিয়েছি । মাঝে রাস্তায় তিনটে পরটা আর ঘুগনি কোনক্রমে এখনো পর্যন্ত পিত্তি পড়া থেকে রক্ষা করছে ।

খানিকদূর হেঁটে গিয়ে এক ধানজমির পাশে ছোট ছোট খেজুর গাছে ঘেরা পুকুর নজরে এলো । একপাশে শানবাঁধানো ঘাট চোখে পড়লো । লুঙ্গি শুকনো পাথরের উপর রেখে ধূলিমাখা দেহটিকে পুকুরের জলে বিসর্জিত করলাম । সারাদিনের পথশ্রমের পর পুকুরের ঠান্ডা জলে গা ভাসিয়ে মনে হল স্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তা বোধয় এই ! সার্বজনীন ব্যবহারের পুকুরে বেশি লম্ফঝম্ফ করলে অন্যান্য লোকেরা আপত্তি করেন । কিন্তু এই অবেলায় কেউ নেই নিষেধ বা আপত্তি করার । আমরা ছাড়া গরুর মতো বেশ দাপিয়ে স্নান করে উঠে এলাম । গামছায় দেহের জল মুছে ভিজে কাপড় ছেড়ে বাড়ির পথে রওনা হবো । কিন্তু এবার দেখা দিল নতুন সমস্যা । সমস্যার সূত্রপাত লুঙ্গি পড়া নিয়ে । কস্মিনকালেও লুঙ্গি নামক বস্তুটি ব্যবহার করিনি । অথচ লুঙ্গি এদেশের প্রায় জাতীয় পোশাকের সমান । রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে লুঙ্গি সর্বত্র বিরাজমান । অবশেষে মেজ আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো । প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করে শেষমেষ নিজের লাজলজ্জা একরকম বিসর্জন দিয়ে আমি ওর সাহায্য নিতে রাজী হলাম । মেজ লুঙ্গিটিকে সামনের দিকে টেনে তার দুটো খুঁট বানিয়ে খানিক গুটিয়ে তাকে আচ্ছা করে পেঁচিয়ে আমার তলপেটের কাছে দু-জায়গায় গুঁজে দিল । বিপদমুক্ত হবার পরও খানিক দ্বিধাবোধ নিয়ে আমি নিজেই লুঙ্গির নীচের দিকে খানিক টেনে দেখলাম খুলে যায় কিনা । যখন দেখলাম মেজ প্যাঁচটা বেশ শক্তভাবেই কষেছে, এবং খুব সাংঘাতিক কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে খুলে যাওয়ার আশঙ্কা নেই, তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ফেরার পথ ধরলাম ।

আতপচাল খাওয়ার চল ওদেশে । ভাত, মুগের ডাল আর মানকচু দিয়ে রাঁধা মাছের ঝোল সাবাড় করে বুঝলাম গলার কাছে বেশ অস্বস্তি অনুভূত হচ্ছে । বৌদি বললেন ও কিছু না, মানকচু খেলে ওরকম একটু হয় । এই বলে খানিকটা পাকা তেঁতুল আমাদের হাতে গুঁজে দিলেন । আমরা ইষ্টদেবতার নাম নিয়ে তেঁতুলের টুকরো মুখে ফেলে উঠে পড়লাম ।

সারাদিনের পথশ্রমের পর পেটে ভাত পড়তেই মন একটু গড়িয়ে নিতে চাইছিল, কিন্তু বাদ সাধলো দেবুদা (দেবব্রত দা) । দেবুদা পেশায় মৃৎশিল্পী । গ্রামের মন্দিরে ও আরও অনেক জায়গাতেই মজুরির বিনিময়ে প্রতিমা গড়ে দেয় । দেবুদা আমাদের বগলদাবা করে মন্দিরের দিকে নিয়ে চলল । আমরা বলতে আমি আর মেজ । আমরা লুঙ্গির উপর একটা করে টি-শার্ট  চাপিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম । খানিক যেতেই একটা বড় ফাঁকা মাঠ এবং তার এককোনে কালীমন্দির চোখে পড়লো । চারিদিক অন্ধকার । মন্দিরের কাছে দুয়েকটা বাল্ব জ্বালিয়ে অন্ধকারকে যেন আরও গাড় করে তুলেছে । তার মধ্যে একদঙ্গল ছেলে দেল নাচের মহড়া নিচ্ছে । ঢাক-ঢোল, করতালের সমবেত ধ্বনিতে কান পাতা দায় । আমরা প্রতিমা দর্শন করে আর খানিক মহড়া দেখে এবং খানিক মশাকে রক্তদান করে ফিরে এলাম । ক্রমে রাত বাড়তে লাগলো । সারা সন্ধ্যে এদিক ওদিক ঘুরে সাড়ে নয়টা নাগাদ বাড়িতে এসে দেখি খেতে বসার তোড়জোড় চলছে । বিকেলে খেয়ে এখনো তেমন খিদে না পেলেও গৃহকর্তাকে বিপাকে না ফেলার জন্য খেতে বসলাম । নামমাত্র আহার করে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । কলকাতা হলে এমন সময়ে শোবার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না, কিন্তু প্রথমত এটি গ্রাম (অতএব চারপাশ অন্ধকার এবং ঝিঁঝিঁপোকার সুমধুর কলরবে মুখরিত) এবং দ্বিতীয়ত আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত । দাওয়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে তার উপরে কাঁথা পেতে বিছানা করা হয়েছে । মশার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশের বিখ্যাত নেটের মশারি আছে । আর যেটা আছে সেটা হল অবদার রাস্তার ওপাশের কপোতাক্ষ নদীর থেকে ভেসে আসা বিপুল হাওয়া । শুতে না শুতেই ঘুমের গভীরে তলিয়ে গেলাম ।

(চলবে . . .)

(প্রতি সপ্তাহে বুধবার একটি করে পোস্ট করার চেষ্টা করবো প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে । উপরের লেখার পরের অংশ অর্থাৎ পর্ব:২ আগামী বুধবার ।)