‘বাংলা’র গ্রাম – গ্রামের বাংলা

Posted on Updated on

[পর্ব : ৮]
কথা ছিল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাব মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে । কিন্তু অন্যান্য দিনের মতই আটটা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর বুঝতে পারলাম সে গুড়ে বালি । সকাল থেকেই এবাড়ি ওবাড়ির মহিলারা হামান দিস্তায় চাল গুঁড়ো করছে । ওবেলা পিঠে হবে । আমাদের বাড়িতে দুই দিদি আর জেঠীমা বারান্দায় বসে পর্যায়ক্রমে আতপচাল গুঁড়ো করে চলেছে । একজনের হাত ব্যাথা হয়ে গেলে আরেকজন করে । আমি গিয়ে একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম । হামান দিস্তায় চাল পিষতে গিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গলদ ঘর্ম অবস্থায় রণে ভঙ্গ দিলাম ।

বেলা দশটা নাগাদ স্নান করতে গেলাম । অপর্ণাদি আর তুষারদা ফিরে যাবে আজ । একই রাস্তায় যাওয়া হবে, তাই একসাথে রওনা হবো ঠিক হয়েছে । সব গোছগাছ করে বেরোতে বেলা বারটা বেজে গেল । কখন পৌঁছব কে জানে ! বড় রাস্তায় উঠতেই একটা ভ্যান পেয়ে গেলাম । ছেলেটি মুসলমান । বাড়ি এই গ্রামেরই ওমাথায় । আমরা উঠে বসলাম । আমি, মেজ, ছোট, কাকাবাবু, তুষারদা, অপর্ণাদি আর ওদের ছোট্ট মেয়ে । মোটামুটি সাড়ে ছয়জন । মটর চালিত ভ্যান ছুটেছে সাঁ সাঁ শব্দ করে । প্রচন্ড হাওয়ায় চোখ মেলা যাচ্ছে না । চালকের বয়স বেশি নয় । যেতে যেতে জানা গেল ভ্যানচালকের বাবা কাকাবাবুর ছোটবেলার বন্ধু । গল্প করতে করতে হলদিপোতা, যদুরডাঙা পেরিয়ে এসেছি । একজায়গায় নেমে পড়লাম । ছেলেটি আর যাবে না ।

ব্রিজের ওপর

 

 ব্রিজের ওপর থেকে . . . .

 

এখান থেকে ভ্যান বদলাতে হবে । অন্য ভ্যানে গোয়ালডাঙা বাজারে এসে যখন নামলাম তখন বেলা একটা বাজতে যায় । তুষারদা আবদার করে বসলো এখানকার স্পেশাল দই না খেয়ে যাওয়া যাবে না । আমাদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকে এক হাঁড়ি মিষ্টি দই অর্ডার দিয়ে ফ্যানের তলায় টেবিলে গিয়ে বসলেন । আমরাও চুপচাপ ঢুকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম । দোকানদার তুষারদার চেনা । একহাঁড়ি দই ছোট প্লেটে ভাগ করে সকলকে দিল । ইচ্ছে না থাকলেও এক চামচ দই মুখে পুরে দিলাম । পরক্ষণে মনের মধ্যে যে অনূভুতিটা হল, তা ‘অপূর্ব’ । নামে মিষ্টি দই হলেও বস্তুটি আদতে টক-মিষ্টি এবং এই গরমে পরম উপাদেয় । চেটেপুটে প্লেট শেষ করে বেরিয়ে এলাম । এখান থেকে তুষারদা সপরিবারে গৃহাভিমুখে যাত্রা করবে । এখান থেকেই ঘটবে আমাদের বিচ্ছেদ । তুষারদা আমাদের অন্য একটা ভ্যানে তুলে রওনা করিয়ে দিল । চলন্ত ভ্যান থেকে আমরা হাত নেড়ে বিদায় জানালাম । মোড়ের মাথায় ভ্যান বাঁক না নেওয়া পর্যন্ত ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ।
চড়া রোদে মাঠের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলেছি । বেলা প্রায় দুটোর কাছাকাছি আমরা শ্যামল মামার গৃহের প্রান্তে ভ্যান থেকে নামলাম । গরমে দুপুরের রোদে প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে ।

 

 শ্যামল মামা

 

শ্যামল মামা মেজর দূর সম্পর্কের মামা হন । তবে ভালবাসায় নিজের আত্মীয়ের থেকেও বেশি । গ্রামেরই প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন । মামী একই স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে । দুই ছেলেসহ সুখের সংসার । অমায়িক ব্যবহার । অজ গাঁয়ে শিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল পরিবার দেখে বড় ভাল লাগলো । মেজর তিন মামা পাশেই থাকে । ছোট ভ্যান থেকে নেমেই চলে গেছে দেখা করতে । আমরাও একটু মুখ দেখিয়ে এলাম । মামী রান্না করছেন । শ্যামল মামা আমাদের আদর আপ্যায়নের তদারকি করছেন । আমি আর মেজ হাতমুখ ধুয়ে টেবিল ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বিছানায় বসলাম । পরমুহূর্তেই মেজ গুলি খাওয়া সৈনিকের মত বিছানায় লুটিয়ে পড়লো । নাড়া দিয়ে বুঝলাম ঘুমে তলিয়ে গেছে । অদ্ভুত প্রতিভা । এই মুহুর্তে কথা বলছে, পরমুহূর্তেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । ক্লান্তির দরুণ আমারও ঝিমুনি আসছিল । মেজর পাশে আমিও বডি ফেললাম । খানিক পরে মামার ডাকাডাকিতে তন্দ্রা কেটে গেল । চোখমুখে জল দিয়ে খেতে বসলাম । ঝুরঝুরে ভাত, আলু দিয়ে উচ্ছে ভাজা, কাঁচকলা দিয়ে রুই মাছ আর দিশি মুরগির ঝোল এবং সর্বপরি দাম দিয়ে কেনা ফিল্টারের জল । মামার রুচি আর মামীর অপূর্ব রান্নার প্রশংসা না করে পারলাম না ।

 

 মামী (শ্যামল মামার স্ত্রী)

শেষপাতে দইটা কোনক্রমে খেয়ে আবার বিছানায় গিয়ে উঠলাম । মামা স্কুলের সময় ছাড়া বাড়িতে সকাল বিকাল টিউশন পড়ান । বিকেলের ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা আসতে আরম্ভ করেছে । মামা পড়াতে বসলেন । আমরা আরেকটু গড়াগড়ি দিয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম । শত বাধা সত্ত্বেও বিদায় চেয়ে নিয়ে মেজর আপন মামাদের ভিটেয় গেলাম বিদায় চাইতে ।

সেকাল ও একাল
 দিদা ও ভাইয়ের সঙ্গে মেজ

একবেলাও না খাওয়ায় মনক্ষুন্ন হয়েছে ওরা । আমরা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানালাম হাতে সময় অত্যন্ত কম । পরেরবার সব হবে । মেজ মামা ছেলেকে গাছে তুলে দিল ডাব পাড়ার জন্য ।

 কচি ডাবের জলে তৃষ্ণা নিবারণ

আমরা ডাবের জল, কাঁচা গরুর দুধ আর বাতাসা খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম ।
এখান থেকে ভ্যান পাবার কোন সম্ভাবনা নেই । অতএব দুটি পা-ই ভরসা । হাঁটা শুরু করলাম । কিছুদূর গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়লাম । শীতের ধান কাটা হয়ে গেছে । বিশাল ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা একটা পায়ে চলা পথ দিগন্তে গিয়ে মিশেছে । সূর্য পশ্চিমে ঢলেছে সবে । গোধূলির রং এখনো আকাশে ছেয়ে আছে । দূরে একদিকে নির্দেশ করে কাকাবাবু বললেন আমরা ওইখানে যাব । কাকাবাবুর নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে বহুদূরে বিন্দুর মত একটা বাড়ির টিনের চাল চোখে পড়লো । এখন এই ভরা পেটে এতদূর হাঁটতে হবে ভেবেই চোখে জল আসছিল । এদিকে মেজ আমায় আস্তে আস্তে জানাল ওর পেটে গুড়গুড় মাদল বাজছে । প্রকৃতির মায়াবী ডাক কতক্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারবে তা জানে না । ভেবে দেখলাম আমার থেকে ওর সমস্যাটা অনেক বড় ।

চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম । একসময় দিগন্তে এসে পৌঁছলাম । একটা ছোট্ট নদী (এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে), তার উপর দিয়ে একটা নৌকো আড়াআড়িভাবে রাখা । আমরা নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে পাড়ানির(খেয়া পারাপারের) কড়ি ফেললাম । এতক্ষণে ভ্যানের দেখা পেলাম । মেজর মুখ দেখে ওর অবস্থাটা অনুভব করার চেষ্টা করলাম । মেজ ওর নিন্মগামী বেগ আর বেশিক্ষণ সামলাতে পারবে না বুঝতে পারছি । আমি ওকে নানা গল্প বলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছি । যদিও আমার গল্প ওর অন্তঃকর্ণে আদৌ প্রবেশ করছে কিনা বোঝা গেল না । অবশেষে সন্ধ্যে গাড় হবার মুখে বাড়ি এসে পৌঁছলাম । মেজ ভ্যান থেকে নেমেই দৌড় দিল । ছোটও ওর বন্ধুদের দেখতে পেয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল । আমি আর কাকাবাবু ভাড়া মিটিয়ে বাড়ি এসে ঢুকলাম ।

বাড়িতে পিঠে তৈরি হচ্ছে । ঘরে গিয়ে শুনলাম মেজ জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে আমাদের এবেলা নেমন্তন্ন । মেজ জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে উঁকি দিতেই আমাদের টেনে নিয়ে বসাল । হাতে হাতে প্লেট চলে এলো । প্লেটে দুরকম পিঠে আর পায়েস । ওবেলার গুরুভোজনের ফলে পেটে এমনিতেই জায়গা নেই, তার উপরে মিষ্টান্ন । কোনরকমে পেটে চালান করলাম । একটু পরেই আবার রাতের খাওয়ার সময় হয়ে যাবে । পেটের কোন অংশে কতটুকু ভরবো সেই জায়গা করতে লাগলাম । আগামীকাল লোটাকম্বলসহ প্রস্থান করবো । আজ অষ্টম দিন বাংলাদেশের মাটিতে আমাদের ঘিরে সন্ধ্যে নামলো । আগামীকাল সন্ধ্যে হয়তো কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে নামবে । স্ট্রীট লাইটের আলোয় বড়ই ফিকে সে সন্ধ্যে । তার ঘনত্ব চোখে লাগে না । এখানে সন্ধ্যে নামারও যেন একটা শব্দ আছে । ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতানে আপ্যায়িত হয়ে সন্ধ্যে আসে সদলবলে । কলকাতার সন্ধ্যের শব্দ ঢেকে যায় মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে ।

রাতে মাংস দিয়ে অল্প করে ভাত এবং তৎসহ আরেকপ্রস্থ পিঠেপুলি সাবাড় করে শুতে গেলাম । কাল সকাল সকাল উঠতে হবে । নইলে পথে দেরি হয়ে যেতে পারে ।

(চলবে . . .)


[আগামীপর্ব অর্থাৎ শেষপর্ব আগামী বুধবার]

Leave a comment